ঢাকা: বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিবার ও দল বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে বলে আলোচনা চলছে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর দু:সময়ে গৃহবধূ খালেদা জিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছিল এ দেশের প্রথিতযশা মেধাবী রাজনীতিবিদ ও গুণীজনসহ অসংখ্য সর্মথক।
জিয়ার সন্তানদের রক্ষায় ও বিএনপিকে টিকিয়ে রাখতে শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন অধ্যাপক ড. এ কিউ এম বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরী, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, লে. কর্নেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান, মেজর জেনারেল (অব.) মাজেদুল হক, মির্জা গোলাম হাফিজ, ওবায়দুর রহমান, কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, ড. খোন্দকার মোশাররফ হোসেন, জেনারেল মীর শওকত আলী, মেজর জেনারেল (অব.) নুরুল ইসলাম শিশু, ড. আর এ গনি, তানভীর আহম্মেদ সিদ্দিকী প্রমুখ। এদের অনেকেই এখন পরলোকগত। আর জীবিতদের অধিকাংশই নানা কারণে দল থেকে সরে আছেন।
বাকিরা ওয়ান-ইলেভেনের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এক ভাগ সংস্কারের পক্ষে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। বাকীরা দুর্নীতির দায়ে জেলবাসী হন। বর্তমানে এদের কয়েকজন দলে থাকলেও মাথায় ওপর মামলার খড়গ থাকায় সাংগঠনিক কাজে অংশ নিচ্ছেন দায়সারাভাবে।
ফলে ‘মাইনাস খালেদা’ ফর্মুলার ধ্বজাধারী সংস্কারপন্থীরাই বিএনপির নেতৃত্বে বেশ শক্তপোক্তভাবে বসে পড়েছেন। এতে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি দেখা দিয়েছে।
এদিকে দু’দফা পূর্ণ মেয়াদে দল ক্ষমতায় থাকায় শক্তিশালী কর্মীরা (সাবেক ছাত্রদল নেতারা) অনেকই টাকা পয়সার মালিক বনেছেন। তাদের সম্পদ রক্ষা ও নিজেদের জীবনের মায়ায় তারা জিয়া পরিবার নিয়ে এখন ভাবছেন কম।
এছাড়া জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর বিএনপি তথা জিয়া পরিবারের ওপর ছিলো সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের সমর্থন। ছিলো আমেরিকা, চীন, পাকিস্তান, জাপান, সৌদি আরবসহ মুসলিম দেশগুলোর সমর্থনও। আর এসব কারণে জিয়া মারা যাওয়ার পর দলটি বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পায়।
কিন্তু ২০০১ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার পর আমলা, চাটুকার ও সুবিধাবাদীদের আখড়ায় পরিণত হয় বিএনপি। বিপরীতে চুপ মেরে যান পরীক্ষিত নেতারা।
ওদিকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে প্রবাসী বিএনপি নেতা কমর উদ্দিনের তত্ত্বাবধানে এতো দিন ভালোই ছিলেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমান। কিন্তু কমর উদ্দিনের মৃতুর পর যুক্তরাজ্যে অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছেন তারেক। নতুন অভিভাবকের খোঁজে এখন তিনি ফ্রান্স যাচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
তার বিরুদ্ধে একুশে আগস্ট আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। দেওয়া হয়েছে মালামাল ক্রোকের নির্দেশ। অর্থ পাচারের মামলায় ছয় বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে তার ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোকে। এ যেন জিয়া পরিবারের জন্য মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে।
সবকিছু মিলিয়ে বিএনপি ও জিয়া পরিবার রাজনৈতিকভাবে বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। বেড়েছে বিপদও।
জিয়াউর রহমানের সময় থেকে বিএনপির সাথে জড়িত সিনিয়র নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ কয়েকজন নেতা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি না হলেও এদের মধ্যে কেউ কেউ জিয়া পরিবার যে এখন বন্ধুহীন এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলটিকে টিকিয়ে রাখতে ওই পরিবার যতো প্রকৃত বন্ধু পেয়েছিল, ওয়ান-ইলেভেনের পর তাদের অধিকাংশই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। ফলে বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে জিয়া পরিবার। দলের নেত্রী এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। ’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নানা ভুলের কারণে কোটি সমর্থক ও নেতা-কর্মী থাকা সত্ত্বেও দলটিতে প্রকৃত বন্ধুর যে অভাব রয়েছে তা বোঝা যায়। জিয়ার মৃত্যুর পর যেসব নেতা এ বিএনপিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তাদের নানাভাবে দূরে সরিয়ে রাখার নজির দলের ক্ষতির কারণ হয়েছে। ’
ওই সময়ের নেতা বি. চৌধুরী, কর্নেল (অব.) অলি আহমেদসহ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দলটিতে তারা থাকলে ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি জিয়া পরিবারকে এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারতো না। ’
অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বলেন, ‘বিএনপির লক্ষ লক্ষ সমর্থক আর নেতা-কর্মী থাকলেও নীতি নির্ধারণী বিষয়ে তাদের ঘনিষ্ট লোকের অভাব রয়েছে। আর সব দলের মতো বিএনপিতেও রাজনীতিকদের চেয়ে আমলা ও তোষামোদকারীদের অবস্থান ভালো। তাই প্রকৃত রাজনীতিবিদরা অনেকটা দূরে সরে আছেন বা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৫ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০১১