কক্সবাজার: ইলিশের ডিমপাড়ার সময়ে সরকার ঘোষিত নিষিদ্ধ সময়ে সরকারি লোকজন ইলিশ ধরা বন্ধের চেয়ে ধরা ইলিশ জব্দেই বেশি তৎপর ছিল। গত ৫ অক্টোবর থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ ধরা নিষিদ্ধের সময় পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন বানের স্রোতের মত ইলিশে সয়লা হয়ে পড়েছে উপকূলীয় মৎস অবতরণ কেন্দ্রগুলো।
এসব ইলিশ সরকারি নিষেধাজ্ঞার সময় অতিক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন হিমাগার এবং শত শত ট্রলারে থাকা রক্ষণাগার থেকে নিয়ে আসা হয় আড়তে। এরই সূত্রে কক্সবাজারের একমাত্র সরকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র গত রোববার রাত ১টা থেকে সোমবার রাত ৭টা পর্যন্ত ইলিশে সয়লাব হয়ে পড়ে। এ অবস্থা পরদিন মঙ্গলবার পর্যন্ত বজায় থাকে।
মাছ ব্যবসায়ী ও জেলেদের ধারণা ওই সময়ের মধ্যে প্রায় ৫০০০ টন ইলিশ অবতরণ কেন্দ্র ও তার বাইরে বেচাকেনা হয়েছে। মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক শাহাদাত হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘ইলিশ ধরার নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর জোয়ারের পানির মতো ইলিশ অবতরণকেন্দ্রে আসতে শুরু কর। ’
আগেরদিন (১৬ অক্টোবর) পর্যন্ত ইলিশ ধরা নিষিদ্ধের সময় পার হওয়ার পর গত সোমবার (১৭ অক্টোবর) তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘বেলা ১২টা পর্যন্ত ২ হাজার টন মাছ বিকিকিনি হয়েছে। এখন সন্ধ্যে সাড়ে ৬টা। রাতে সব হিসেব হবে। ’
মৎস ব্যবসায়ীরা জানান, মঙ্গলবারও এ অবস্থা বিরাজমান থাকবে।
শাহাদাত হোসেন আরও বলেন, ‘বোটের মালিকেরা অনেকেই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের বাইরে মাছ বিক্রি করে দিচ্ছেন। যে মাছগুলো কেন্দ্রে আসছে সেগুলোর হিসেব আছে। অন্যগুলোর হিসেব আমাদের কাছে থাকেনা। ’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, অবতরণ কেন্দ্রে আসা প্রতিটি ইলিশের পেটে ডিম রয়েছে। বেশিরভাগ মাছের পেট ছিঁড়ে ডিম বেরিয়ে গেছে। আর একটু সময় পেলেই এসব মাছ ডিম ছাড়তে পারতো।
কক্সবাজার মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক আবু বকর ছিদ্দিক বাংলানিউজকে বলেন, ‘ইলিশ নিধন বন্ধে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। শুধু কক্সবাজার মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে রোববার রাত থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৫ হাজার টনেরও বেশি মাছ বেচাকেনা হয়েছে। এখনও বিক্রির অপেক্ষায় আছে অনেক মাছ। এসব দেখে মনে হয়- সরকার আসলে ইলিশ নিধন বন্ধে অন্তরিক ছিলনা। ’
তিনি বলেন, ‘এসব মাছ দেখে শিশুরাও বুঝবে সেগুলো নিষিদ্ধ সময়ে ধরা মাছ। গত ৫ অক্টোবর রাত থেকে যদি সরকার মহেশখালী চ্যানেলের নাজিরার টেক এলাকায় পাহাদা বসাতো তাহলে কক্সবাজার, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়ার হাজার হাজার বোট মাছ ধরতে যেতে পারতো না। সরকারের লোকজন মাছ ধরা বন্ধের চেয়ে ধরা মাছ জব্দে বেশি তৎপর ছিলো। ’
কক্সবাজার বোট মালিক সমিতির সভাপতি শহর আওয়ামীলীগের সভাপতি মুজিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘সরকার মাছ ধরা বন্ধে কাজ শুরু করে মূলত তিন তারিখ থেকে। ছয় তারিখ থেকে নিষিদ্ধ সময় শুরু হয়। তবে জেলেদেরকে সচেতন করার কাজ তেমন কিছুই নজরে পড়েনি। কোনও পোস্টারিং, মাইকিং ছিলো না। বোট মালিকদের সাথে আগেভাগেই বসাসহ করণীয় নির্ধারণ করে, সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক কার্যক্রম হাতে নেওয়া উচিত ছিলো। ডিসির সম্মেলন কক্ষে দায়সারা গোছের একটি সভা করে ১২০ কিলোমিটার সমুদ্র ও ৬ হাজার বোট তদারকি করা সম্ভব নয়। নৌ বাহিনী ও কোস্টগার্ডকে সংশ্লিষ্ট জায়গায় পাহারা বসিয়ে বোট কন্ট্রোল করলে লক্ষ লক্ষ ডিমওয়ালা মাছ রক্ষা পেতো। এ মাছগুলো ছিলো আমাদের সম্পদ। ওদের রক্ষা করতে পারিনি আমরা। ’
কক্সবাজারের বিশিষ্ট মাছ ব্যাবসায়ী সৈয়দ আলম বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা জাতে চোর। চোরদের পেছনে বেত না মারলে তারা সোজা থাকে না। বোট তদারকিতে বেতের ব্যবহার থাকাটা বাঞ্ছনীয় ছিলো। আজ ডিমওয়ালা মাছের করুণ পরিণতি দেখলে কলিজা ফেটে যায়। এগুলো দেশের সম্পদ, আমাদের রিজিক। সরকারের দায়সারা ভাব আমাদের আহার বন্ধ করে দেবে আগামীতে। ’
তবে যোগাযোগ করলে জেলা প্রশাসক জয়নুল বারী বাংলানিউজকে বলেন, ‘সীমিত লোকবল ও যোগাযোগ সামগ্রী নিয়ে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন মৎস্য বিভাগকে নিয়ে সর্বাত্মকভাবে তদারকি করা হয়েছে। জেলায় প্রায় ৩ হাজার টন মাছ জব্ধ করা হয়েছে। ওগুলো নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে। সমুদ্রে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড তৎপর ছিলো। আসলে পুরো সমুদ্রে নিষেধাজ্ঞা ছিলো না। নির্দিষ্ট কিছু পয়েন্টে নিষেধাজ্ঞা ছিলো। তাই বোট তদারকি করা ছিল খুবই কঠিন। এর মধ্যেও যথাসম্ভব আমরা চেষ্টা করেছি। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৯১০ ঘণ্টা, ১৮ অক্টোবর, ২০১১