ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

চরে বাহিনীর দরকার আছে : হাতিয়া পৌর মেয়র

রহমান মাসুদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩২ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০১২
চরে বাহিনীর দরকার আছে : হাতিয়া পৌর মেয়র

চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও ভোলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এক জনপদ। প্রকৃতির খেয়ালের ওপর ভর করে চলে এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা।

তার ওপর জলে-স্থলে দস্যুদের অতর্কিত হানা এখানকার মানুষকে রাখে চরম অনিরাপত্তায়। পুরোটাই এক সন্ত্রাসের উপকূল। এই বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে এক পক্ষকাল চষে বেড়িয়েছেন বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট রহমান মাসুদ ও ফটো করেসপন্ডেন্ট উজ্জ্বল ধর। তুলে এনেছেন সন্ত্রাসের ওই জনপদের অনেক সচিত্র কাহিনী। সোমবার পঞ্চম কিস্তি...

জলদস্যুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হাতিয়ার তিন লাখ চরবাসী। এখানকার ভোটারের সংখ্যাও কম নয়। ৩৮ হাজার ৮০০ জন ভোট দিয়েছেন ২০০৮ সালের সংসদ ও গত উপজেলা নির্বাচনে। এই ভূমিহীন ভোটারদের নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীরা করেন রাজনীতি। আর ভোটারদের নিজের হাতে রাখতে অন্যান্য অনেক কৌশলে সঙ্গে লালন করেন দস্যু বাহিনী।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা (বহিষ্কৃত) মোহাম্মদ আলী বর্তমানে দস্যুসম্রাট নিজাম চৌধুরীকে (নিজাম ডাকাত) লালন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাকে এ কাজে সহযোগিতা করছেন হাতিয়া পৌরসভার মেয়র একেএম ইউসুফ আলি। মেয়র মনে করেন, চরের আধিপত্য ধরে রাখার জন্য বাহিনীর প্রয়োজন রয়েছে।

নিজাম ডাকাত বাংলানিউজকে বলেন, তিনি কোনো রাজনৈতিক দলে বিশ্বাস করেন না। তবে মোহাম্মদ আলী ও মেয়র ইউসুফ আলী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাই তিনিও আওয়ামী লীগ করেন।

অভিযোগ আছে, হাতিয়া পৌরসভার জন্য স্থানীয় সরকারের দেওয়া ডাম্প ট্রাকটিও মেয়র ইউসুফ দিয়ে দিয়েছেন নিজামকে। চরের ধান সংগ্রহের জন্য তিনি এটি ব্যবহার করেন।

ইউসুফ আলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘চরে ভূমি বণ্টন এবং তা ব্যবহারের জন্য আধিপত্য বিস্তারের প্রয়োজন। এজন্য বাহিনী দরকার। বিশেষ করে, সাধারণ প্রশাসন যেখানে অনুপস্থিত সেখানে বাহিনী না থাকলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ’

তিনি বলেন, ‘চরে একজনের ওপর দাঁড়িয়ে আরেকজন পার হয়। এগুলো হয়তো আপনারা যারা বাইরের মানুষ, তাদের কাছে রোমহর্ষক। কিন্তু আমাদের মতো স্থানীয়দের কাছে তা খুবই স্বাভাবিক। ’

ইউসুফ আলি বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতাই চরের এসব বিকল্প বাহিনীর উত্থান এবং বিস্তারের মূল কারণ। এখানকার ইতিহাস বড়ই করুণ এবং হৃদয়স্পর্শী। হাজার হাজার ভূমিহীন নদীর বুকে সব হারিয়ে সাগর ও জেগে ওঠা ওইসব চরে গিয়ে ভিড় করে। এর আগেই অবশ্য এক ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী (বাহিনী) ওই চরগুলোয় তাদের ঘাঁটি গাঁড়ে। প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত হয়। ’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘স্থানীয় সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রশাসনিক কারচুপির মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এ নির্বাচনের পর থেকে এ অঞ্চলে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক রেষারেষিতে অনেক দাঙ্গাহাঙ্গামা হয়েছে, মামলা মোকদ্দমা হয়েছে। যারা আসামি তাদের বেশির ভাগই দোষী নয়, সাধারণ ভূমিহীন। ’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে চরে রাজনৈতিক কারণে একটা পক্ষ গোপনে নানা সহিংস ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। একদিন সকালে ক্যারিংচরের মুজিব বাজারে আমরা একটি সভা করি। এরপর বিকালেই বাসার মাঝির মেয়ের জামাই নবী মাঝিকে (নবী ডাকাত) ধরে নিয়ে যাওয়া হয় র‌্যাব পরিচয়ে। তাকে আজও পাওয়া যায়নি। আমি ও সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী নবী মাঝির ব্যাপারে র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করি। র‌্যাব এ ঘটনাকে অস্বীকার করে। ’

এভাবে চরে প্রতিদিনই অসংখ্য গুপ্ত হত্যা চলছে বলেও জানান তিনি। আর এসবের জন্য সরাসরি দায়ি করেন বর্তমান সংসদ সদস্য ফজলুল আজিমকে।

ইউসুফ আলী বলেন, ‘বাসার মাঝি শেষ জীবনে এসে সংযত হয়েছিলেন। তিনি সাধারণ মানুষের জন্য সামাজিক কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি রুই মাছের ডিম এনে পুঁঠি মাছদের খাওয়াতেন (বড়লোকের টাকা এনে গরিবকে খাওয়াতেন)। ’

মেয়র ইউসুফ আরো জানান, বাসার মাঝির মেয়ের জামাই নবী মাঝি ১০/১২টি ব্রিক ফিল্ডে চরের সাধারণ মানুষদের কাজ দিতেন। চেয়ারম্যান ঘাটে তার মাছের ব্যবসা ছিল। সাগরে তার বড়বড় জাল ছিল। সেখান থেকে তার প্রতিদিন লাখলাখ টাকা আয় হতো। (এ অঞ্চলের মাছের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন নবী মাঝি। হাজার হাজার জেলে তার কাছে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হতেন। নবীর মাধ্যমে জেলেরা নদী ও সাগরে মাছ ধরার পারমিট সংগ্রহ করতো। )

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি চরের ১০টি কেন্দ্রে পুনঃভোট হওয়া প্রয়োজন। এ নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। আজিম সাহেব এসব ঠেকাতে চরে গুপ্ত হত্যা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছেন। আমি মনে করি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে চরে বর্তমান এমপি, নিজাম বাহিনীর বিরুদ্ধে গোপনে আর একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ দাঁড় করিয়েছে। তারাই গুপ্ত হত্যা চালাচ্ছে। ’

তিনি জানান, চরের অবস্থা বর্তমানে খুবই উত্তপ্ত। সামনে বর্ষা মৌসুম আসছে। সারাদেশ থেকে এ এলাকায় লাখ লাখ ইলিশ ধরার নৌকা আসবে। প্রতিদিন শতশত কোটি টাকার ইলিশ উঠবে। এছাড়া চরের লাখলাখ একর জমিও বর্ষা মৌসুমে চাষ শুরু হবে। এসব সামনে নিয়েই চর ক্রমশঃ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাদের এমপি মনে-প্রাণে চান না চর থেকে দস্যুতা দূর হোক। তিনি তা চাইলে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে গোপনে বা একান্ত বৈঠকের মাধ্যমে সন্ত্রাস এবং দস্যুতা দূর করার চেষ্টা চালাতেন। তিনি তা না করে সংসদে এ নিয়ে কথার বান ছোটান। এতে সরকার বিব্রত হয়। এমপির কথামতো চরে অভিযান চালালে তার কথাই সত্য প্রমাণিত হয়। এজন্য, সরকারও ইচ্ছা থাকা সত্বেও কিছু করতে পারছেনা। ’

এসপিকে সরিয়ে নিলে অবস্থার উন্নতি হতো- এমপি আজিম
এদিকে হাতিয়ার চলমান পরিস্থিতির জন্য সাবেক সাংসদ মোহাম্মদ আলী, পৌর মেয়র ইউসুফ আলী এবং নোয়াখালীর পুলিশ সুপারকে দায়ি করেছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম।

তিনি বলেন, ‘বর্তমান নোয়াখালির পুলিশ সুপারকে প্রশাসন থেকে সরিয়ে নিলেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ’

একই সঙ্গে এমপি তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগও অস্বীকার করেন।

তিনি বলেন, ‘বর্তমান পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ হাজারীকে প্রশাসন থেকে সরিয়ে নিলে জলদস্যুতা, বনদস্যুতা এবং ভূমিদস্যুতা পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হতো। ’

তিনি বলেন, ‘এসপিই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। সে এমন একটা অবস্থান তৈরি করেছে যে এতো বছর পরও সে বদলি হয়না। প্রতি মৌসুমে সে কোটি কোটি টাকা ভাগ নেয়। মোহাম্মদ আলী ও চাটখিলের জাহাঙ্গীরের (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা) মাধ্যমে সে এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন করে। ’

ফজলুল আজিম বলেন, ‘কিছুদিন আগেও ক্যারিংচরে ৩৮জন জলদস্যুকে আটক করে ভূমিহীনরা। পরে তাদের হাতিয়া থানা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের পর এসপির নির্দেশে পুলিশ তাদের ছেড়ে দেয়। ’

তিনি বলেন, ‘ইলিশ মৌসুমে এ এলাকায় কয়েক লাখ জেলে নৌকা আসে। এসব নৌকা পিছু মাছ ধরার জন্য জলদস্যুরা ছোট নৌকা ১০ হাজার ২০০ টাকা এবং বড় নৌকা থেকে ২০ হাজার টাকা আদায় করে। এ হিসেবে প্রতি ইলিশ মৌসুমেই এ অঞ্চল থেকে জলদস্যুরা আদায় করে শতশত কোটি টাকা। এছাড়া চেউয়া মৌসুমে নৌকাপ্রতি ২০ হাজার টাকা ও চিংড়ি মৌসুমে ও ১০ হাজার করে টাকা আদায় করে ডাকাতরা। তবে এ দুই মৌসুমে জেলে নৌকা কম আসে। ’

স্থানীয় এ সংসদ সদস্য বলেন, ‘বর্তমান এসপি এ টাকার ভাগ পায়। এ টাকা ঢাকার অনেক বড় জায়গায় যায়। আর তাই প্রশ্ন ওঠে- একজন পুলিশ সুপার কি করে এতো বছর এক জায়গায় থাকে! ৫বার বদলি আদেশের পরও তিনি থেকে গেলেন কী করে?’

ফজলুল আজিম বলেন, ‘আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, আইজির কাছে বিষয়টা কয়েকবার বলেছি। কোন কাজই হয়না। এরপর জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়েও কয়েকবার বলেছি। কাজ হয়না। যেখানে সংসদে বললেও কাজ হয়না, সেখানে বলে কী লাভ?’

তিনি বলেন, ‘মুন্সীয়া অনেক বড় ডাকাত ছিল। বাসার মাঝিও বড় ডাকাত ছিল। এরা নিজেদের যুদ্ধ ও র‌্যাবের হাতে মারা গেছে। এটা মানুষের জন্য রহমত। এটা ছাড়া মানুষ বাঁচবে না। এছাড়া যোগাযোগ অবস্থার উন্নতি ঘটলে চরের মানুষ এসব থেকে মুক্তি পেত। ’

তিনি বলেন, ‘যারা মুল ধারার আওয়ামী রাজনীতি করে তারা কিন্তু ভূমিহীনের পক্ষ্যে জলদস্যুদের বিপক্ষে। তবে হাতিয়ায় একজন গড ফাদার আছেন, মোহাম্মদ আলী। তিনি হাতিয়ায় আসলে শতশত জলদস্যু নিয়ে আসেন। বাসার মাঝির সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক ছিল। বাসার মাঝি চরে মোহাম্মদ আলীকে ১০০ একরের একটি খামার করে দিয়েছিল। এখন সে খামার নিজাম দেখাশোনা করে। মোহাম্মদ আলীর মিসেস সেখান থেকে ফসল বুঝে আনে। তিনি চরে গিয়ে নির্ভয়ে ডাকাতদের সঙ্গে থাকেনও। ’

আজিম বলেন, ‘প্রশাসন যদি শক্ত হতো, পুলিশ এবং কোস্টগার্ড যদি শক্ত অবস্থানে যেতো তাহলে মানুষ নির্ভয় হতে পারত। কিন্তু এখানে পুলিশ প্রশাসন বলে কোনো প্রশাসন নেই। কোনো অফিসার কোনো দস্যুকে আটক করলে তাকে শিবিরকর্মীর অপবাদ দিয়ে ক্লোজ করা হয়, এটাই এখানকার চিত্র। মোহাম্মদ আলীর এক ভাই পুলিশের ডিআইজি (মাহাবুব)। তারে দিয়েই মোহাম্মদ আলি সব কব্জা করে রাখছে। ’

এমপি সাহেব সত্য কথা বলে না- এসপি হারুন

তবে স্থানীয় সংসদ সদস্য ফজলুল আজিমের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নোয়াখালীর পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ হাজারী।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘এমপি সাহেব রাজনীতির খাতিরে কখনো সত্য কথা বলেন না। ’

তিনি বলেন, ‘এমপি সাহেব রাজনীতি করেন। নানান কথা বলেন। তার অন্তরে এক আর মুখে আর এক। ’

পুলিশ সুপার আরও বলেন, ‘তার অভিযোগের বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। ’

তিনি বলেন, ‘ফজলুল আজিম সাহেবের অভিযোগ সম্পর্কে আমি শুধু বলব, তিনি সংসদে দাঁড়িয়েও আমার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেছেন। আমার বিষয়ে সংসদীয় তদন্ত কমিটি হয়েছে। ডিজিএফআই, এনএসআই, এসবি আমার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে। ’

এসপি হারুন বলেন, ‘এসব তদন্তে যদি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো সত্যতা মিলতো তাহলে নিশ্চয়ই সরকার আমাকে প্রত্যাহার করে নিত। ’

বাংলানিউজের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে চরের অবস্থা স্থিতি পর্যায়ে আছে। তবে কখণ পরিস্থিতি খারাপ হবে এটা বলা যায়না। যে কোনও সময় অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। এটাই চরের আইনশৃঙ্খলার ধর্ম। ’

হাতিয়ার জলদস্যুদের ইতিবৃত্ত
১৯৯১-র প্রলয়ংকারী জলোচ্ছাসের পরপরই নদী ভাঙ্গন কবলিত হাতিয়ার চারপাশে মেঘনা এবং বঙ্গোপসাগরের বুকে পলি জমে নতুন নতুন চর জেগে ওঠে। নব্বই দশকের শেষের দিকে আওয়ামীলীগ সরকার নতুন জেগে উঠা এসব চরে ম্যানগ্রোভ বনায়ন শুরু করে।

১৯৯৮ সালের গোড়ার দিকে বাশার মাঝি, নব্বা চোরা, শফি বাথাইন্না, সোলেমান কমান্ডারসহ প্রায় ১ ডজন জলদস্যুর উত্থান ঘটে এসব চরে। প্রশাসনের নজরের আড়ালে থেকে এসব জলদস্যু মেঘনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ত্রাস সৃষ্টি করতে থাকে। তারা ম্যানগ্রোভ বনায়ন প্রকল্পের গাছ নিধন করে জেগে ওঠা চরগুলোতে আশ্রয় নেওয়া ভূমিহীনদের কাছে জমি বিক্রী শুরু করে। সেময় বনদস্যু-ভূমিহীন ও দস্যু-দস্যু সংঘর্ষে বহু ভূমিহীন ও দস্যু নিহত হয়।

২০০৩ সালের ৬ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর দস্যু নির্মূল অভিযানে এসব চরে প্রায় অর্ধশত দস্যু নিহত হয়। সেসময় বেঁচে যায় বাশার মাঝি। পরে বাশার মাঝি দলছুট হয়ে পড়া অন্যান্য দস্যু বাহিনীর সদস্যদের একত্রিত করে গড়ে তোলে এক বিশাল বাহিনী- চরে শুরু হয় তার একচ্ছত্র আধিপত্য। এ বাহিনীর নাম হয় বাশার বাহিনী।

সে থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় চরাঞ্চলে বলা যায় রাম রাজত্ব কায়েম করে বাশার বাহিনী।

বাশার মাঝির অধীনস্থ কমান্ডারদের মধ্যে আলোচিত ছিল- মিয়া শিকদার, মালেক ফরাজি, মতিন কশাই, গরু করিম, বাহার কেরানি (বর্তমানে নিজাম বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড), হাত কাটা হারুন, নিজাম ডাকাত, নাছির কেরানীসহ প্রায় ৫ শতাধিক জলদস্যু। বেপরোয়া এসব দস্যুনেতা হাতিয়ার বয়ারচর, নলেরচর, ক্যারিংচর, চরবাশার, জাহাইজ্জার চর, ঢালচর, উড়িরচর, ঠাঙ্গারচর, চর ইসলামসহ উপকূলীয় মেঘনায় ডাকাতি, হত্যা, নারী ধর্ষণ, বনউচ্ছেদসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাত।

অপরদিকে, হাতিয়া উপজেলা এলাকায় বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা জাহাজমারার কালাম চরে আস্তানা তৈরি করে মেঘনার অপর জলদস্যু কালা বাদশা। ২০০৯ সালের ১৬ অক্টোবর শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা বাদশা পুলিশের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে নিহত হয়। কালা বাদশার তৈরি করা আস্তানা পরবর্থীতে দখল করে নেয় মুন্সিয়া ডাকাত। তার বাহিনীর নাম হয় মুন্সিয়াবাহিনি। মুন্সিয়া ডাকাত এখান থেকে পুরো বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত। সেসময় মুন্সিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে চর চ্যাঙ্গার অপর জলদস্যু ইব্রাহীম ডাকাত।

এরই সূত্র ধরে ২০১০ সালের ১৯ মে মুন্সিয়া ডাকাত ও ইব্রাহীম ডাকাতের মধ্যে বন্দুক যুদ্ধে ইব্রাহীম ডাকাতসহ তার অধীনস্থ কমান্ডার সুমন ও মনপুরার পিচ্চি খোকাসহ উভয় পক্ষের ৩০ সদস্য নিহত হয়।

২০১০ সালের ৬ জুন র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয় বনদস্যু বাশার মাঝি। বাশার মাঝির মদদে ছিলেন হাতিয়ার সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলি। বাশার মাঝির মারা যাওয়ার পর দায়িত্বগ্রহণ করে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড নাসির কেরানী। তখন বাশার বাহিনীরই নাম হয় নাসির বাহিনী। এলাকার জনশ্রুতি মতে- এ পর্যায়ে নাসির বাহিনীর কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করেন মোহাম্মদ আলী। কিন্তু ক্রস ফায়ার থেকে বাশার মাঝিকে বাঁচাতে না পারার ব্যর্থতার কারণ দেখিয়ে মোহাম্মদ আলীকে চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে নাসির। এ নিয়ে মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে বিরোধ বাঁধে নাসির কেরানীর।

এদিকে, মুন্সিয়া চোরা নিজ দলীয় কোন্দলে নিহত হওয়ার পর ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় তার দল। বিলুপ্ত প্রায় মুন্সিয়া বাহিনীর সদস্যদেরকে একত্রিত করে বাশার মাঝির থার্ড ইন কমান্ড সুর্বনচরের নিজাম ডাকাত গঠন করে নিজাম বাহিনী।

একপর্যায়ে নাসির কেরানী র‌্যাবের হাতে আটক হয়েছে এমন খবরের পর ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় নাসির গ্রুপ। ফলে নাসির তথা বাশারের আস্তানা দখল করে নেয় নিজাম ডাকাত। বর্তমানে জাহাইজ্জার চরে আস্তানা নিজাম ডাকাতের। বাশার মাঝির অনেক বিশ্বস্ত কর্মী এখন নিজাম বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছে। নিজামের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করছেন বাহার কেরানী।

হাতিয়ার মূল ভূখণ্ডের পশ্চিমভাগে তমিরুদ্দী এলাকায় দস্যুতা করছে হক বাহিনি। তবে কোস্টগার্ড জানায়, তার কর্মকাণ্ড সীমিত রয়েছে জাঙ্গলার চর, ঢালচর ও ভোলার মনপুরা এলাকায়।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলার জন্য গত কয়েকদিন যাবত সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর মোবাইল ফোনে বারবার কল করেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি কল রিসিভ করছেন না। এমনকি তার বক্তব্য চেয়ে এসএমএস দিলেও কোনও জবাব দেননি মোহাম্মদ আলী। এ কারণে তার মতামত দেওয়া গেল না।

বাংলাদেশ সময় : ১৪১৯ ঘণ্টা, ১৯ মার্চ, ২০১২

সম্পাদনা : রানা রায়হান, অ্যসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর/আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।