চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও ভোলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এক জনপদ। প্রকৃতির খেয়ালের ওপর ভর করে চলে এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা।
হাতিয়ার সেন্টার বাজারের আবুল হাসেমের দুই ছেলে শাহিন এবং হাসান নৌকা নিয়ে ধান আনতে গিয়েছিল ক্যারিংচরের বাথানখালি বাজারে। নিজেদের নয়, ভূমিহীন এই দুই সহোদর আনতে গিয়েছিল এক ব্যাপারীর ধান। নৌকাটি নদী পেরিয়ে খালে ঢোকার মুখেই বাহার কেরানীর নেতৃত্বে জলদস্যুদের একটি দল তাদের আটক করে। এরপর ব্যাপারীর কাছে মুক্তিপণ দাবি করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যাপারী বিপুল অংকের মুক্তিপণ দিতে রাজি না হওয়ায় হাসান ও শাহিনকে হত্যা করেন নিজাম বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড বাহার কেরানী। তাদের পেট কেটে মেঘনায় ভাসিয়ে দেন। এর আগে ব্যাপারীর কাছে ফোন করে কথা বলান ওই দুই সহোদরকে দিয়ে। নিজেদের কণ্ঠেই তারা মৃত্যুর দুঃসংবাদ পৌঁছে দেন স্বজনের কাছে। এখনো তাদের মা নলের চরে পাগলের মতো খুঁজে বেড়ান দুই সন্তানের মৃতদেহ। বাড়িতে অপেক্ষায় মৃত শাহিনের স্ত্রী এবং একমাত্র শিশু সন্তান।
হাতিয়ার চরাঞ্চলে এমন রোমহর্ষক ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটে বলে জানালেন নিহত হাসান ও শাহিনের মামা সাবেক ইউপি মেম্বার নুর হোসেন। দুইদিন ধরে চরে খুজেঁও পাওয়া গেল না হত্যার শিকার দুই সহদরের পাগলপ্রায় গর্ভধারীনীকে। জোগাড় হলো না তাদের কোনো ছবিও।
শাহিন ও হাসানের মামা নুর হোসেন বলেন, ‘এ ঘটনার পর থেকে শাহিন এবং হাসানের বাবা-মা পাগলের মতো খুঁজে ফিরছেন সন্তানদের। অন্যদিকে শাহিনের স্ত্রী বাপের বাড়িতে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছেন শিশু সন্তানকে নিয়ে। তারা বিশ্বাস করতে চান না, প্রিয় স্বজন চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ফিরবেন না কোনো দিনই। ’
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হাতিয়া পৌর চেয়ারম্যান একেএম ইউসুফ আলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘এমন ঘটনা চরে অহরহ ঘটে। এটা এখানকার জন্য খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনারা যারা বাইরে থাকেন তাদের জন্য তা রোমহর্ষক হতে পারে। ’
চরের আড়াই লাখ ভূমিহীন জিম্মি হয়ে আছে এ জলদস্যুদের হাতে। বর্তমানে এর নেতৃত্বে আছে নিজাম বাহিনী। কিন্তু ভয়ে কেউই মুখ খোলেন না এ বিষয়ে।
কেবল হাতিয়াতেই বা কেন! খোকা বাহিনীর হাতে নিহত উড়িরচরের জাহাঙ্গীর মেম্বার তিন বছর আগে খুন হন জনসম্মুখেই। শালিসের কথা বলে জাহাঙ্গীরকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ফেরার পথে অন্য দুই মেম্বার ও গ্রামবাসীর সামনেই খোকা, সুফিয়ান, শাহিন, মহব্বত, হাফেজ, দুলাল মেম্বার, কাশেমসহ ২০/২২ জনের একটি গ্রুপ জবাই করে তাকে। এ হত্যাকাণ্ডের পর বাড়ি থেকেও উচ্ছেদ করা হয়েছে জাহাঙ্গীরের পরিবারকে। বর্তমানে এ পরিবারের আশ্রয়স্থল উড়িরচরের শেখ হাসিনা আশ্রয় কেন্দ্রে।
মৃত জাহাঙ্গীরের বড় ছেলে সাইফুল বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের বাড়িটি ‘ভুতের বাড়ি’ হিসেবে এখন উড়িরচরে পরিচিত। বাড়িতে গেলে আমাকেও খুন করা হবে বলে হুমকি দিয়েছে সন্ত্রাসী খোকা। ’
তিনি বলেন, ‘যেদিন মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে, সেদিন সন্দ্বীপের ওসি আমাকে থানায় যেতে ফোন করেন। অন্যদিকে খোকা ও তার ভাই আমাকে ঠেকানোর জন্য অস্ত্র নিয়ে পাহারা দেন। এরপর আমার মা আমাকে হারানোর ভয়ে আর থানায় যেতে দেননি। ’
তিনি বলেন, ‘এ সুযোগে খোকার লোকজন ওসিকে দিয়ে চার্জশিট থেকে মূল আসামিদের বাদ দিয়ে মামলার সাক্ষীদের আসামি করে চার্জশিট দেয়। ’
সাইফুল জানান, এ হত্যাকাণ্ডের পর পরিবারের পক্ষ থেকে একটি জিডি করার পর পুলিশ দুলাল মেম্বার, লিয়াকত, জাসু ও মহব্বতকে আটক করে। পরে তাদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে পুলিশ হত্যা মামলা দায়ের করে। কিন্তু চার্জশিটের দিন খোকা খুনের হুমকি দিলে মৃত জাহাঙ্গীরের ছেলে সাইফুল থানায় যাওয়া থেকে বিরত থাকে। এ অবস্থায় মামলার মূল আসামিদের বাদ দিয়ে এ হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী বাবুল সেক্রেটারি, হান্নান ও বাহার মেম্বারকে আসামি করে পুলিশ চার্জশিট দেয় (এরা সবাই ওই সালিশ শেষে জাহাঙ্গীর মেম্বারের সঙ্গে ফিরছিল এবং সবাই খোকা বাহিনীর হামলায় গুরুতর আহত হন)। বর্তমানে মামলাটি আদালতে বিচারাধীন।
২০১১ সালের হাতিয়ায় জলদস্যুদের রক্তাক্ত ইতিহাস
কেবল ওপরের দুটি ঘটনাই নয়, ২০১১ সালের ১৮ জানুয়ারি চর বাশারে দস্যুদের গুলিতে নিহত হন ভূমিহীন গিয়াস উদ্দিন (৪২), রায়হান (০৯), মাইন উদ্দিন (৮৫), লিটন (৩৫), আব্দুল জলিল ওরফে আর্মি (৪২) ও ভুট্টুসহ (৩৮) ১০ জন নিহত হন। তবে নিহতদের লাশ পেট কেটে ফেলে দেওয়া হয় মেঘনায়। লাশের সন্ধান পায়নি তাদের স্বজনরা।
১৬ মার্চ হাতিয়ার মেঘনা নদীতে জলদস্যুর গুলিতে নিহত হন রুবেল (২৩) নামের এক জেলে।
২৪ মার্চ মুন্সিয়া বাহিনীর সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে লাঞ্ছিত হন সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম। ২১ মার্চ জাতীয় সংসদে মেঘনার জলদস্যুদের বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেন। এর তিন দিন পর ২৪ মার্চ বড় ছেলে ফারহান আজিমসহ নির্বাচনী এলাকা হাতিয়ায় আসার পথে চেয়ারম্যান ঘাটে পুলিশের সামনেই মুন্সিয়া বাহিনী সশস্ত্র প্রতিরোধে গড়ে তোলে। এ সময় দস্যুরা আজিমের ওপর ইটপাটকেল ও কাদা মাটি নিক্ষেপ করে তাকে লাঞ্ছিত করে। তিনি ঢাকা ফিরে যেতে বাধ্য হন। এর আগের বছরের ৮ সেপ্টেম্বর ইদুল ফিতর উপলক্ষে হাতিয়ায় ফেরার পথেও এই দস্যুবাহিনীর হাতে তিনি লাঞ্ছিত হন।
১০ মে মঙ্গলবার মেঘনার জলদস্যু নিজাম ডাকাত ও নাছির গ্রুপের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে স্থানীয় বাসিন্দা জামাল বাতাইন্না (৫৫) নিহত ও সিরাজ কমান্ডার (৩৮), আজহার কমান্ডার (৩৫) এবং ফরিক কমান্ডার (২৭) নামে চার দস্যু গুলিবিদ্ধ হয়।
২ জুলাই বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মেঘনায় জলদস্যু মুন্সিয়া বাহিনী ও নিজাম ডাকাত গ্রুপের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে ৮ দস্যু নিহত হয়।
৩ জুলাই রোববার সকালে জলদস্যুরা মেঘনার বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালিয়ে ৩০ মাছ ধরা ট্রলারসহ ৩ শতাধিক জেলেকে অপহরণ করে। পরদিন সোমবার একই দস্যুরা আবারও তাণ্ডব চালিয়ে ৫০ মাঝি- মাল্লাকে অপহরণ করে। পরে বিভিন্ন সময়ে তাদের কয়েকজনকে লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
৫ জুলাই রোববার দিবাগত রাত ২টায় মেঘনার অর্ধশতাধিক মামলার আসামি কুখ্যাত জলদস্যু মুন্সিয়া বাহিনীর প্রধান মুন্সিয়া চোরা তার সদস্যদের আন্তঃকোন্দলে নিহত হন। এতে তার বাহিনীর অত্যাচার থেকে কিছুটা শান্তি পায় দক্ষিণাঞ্চলের জেলেরা।
১৮ জুলাই মেঘনা নদী থেকে জলদস্যুদের হাতে গলাকাটা এক অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
৩ আগস্ট বুধবার দুপুরে একই দস্যুরা চাঁদার দাবিতে বয়ারচর মাইন উদ্দিন বাজার এলাকার ভূমিহীন সাদ্দাম হোসেনকে অপহরণ করে হাত কেটে দেয়। একই দিন নলেরচর ভূমিহীন বাজার এলাকার মিরাজ উদ্দিন আবু জাফর, আব্দুল মতিনসহ কয়েকজন ভূমিহীনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে দস্যুরা সাদ্দাম ও সেলিমের হাত কেটে দেয়।
১৫ আগস্ট সোমবার সকালে জলদস্যু নিজাম ডাকাত উপজেলার নলেরচরের জনতাবাজার থেকে নলের চরের প্রশাসনিক মেম্বার আব্দুল খালেককে (৬৫) আপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে পুলিশের সহযোগিতায় ছাড়া পায় খালেক মেম্বার। ১৭ আগস্ট বুধবার জলদস্যুদের হামলায় ৫ জেলে আহত হয়। এ সময় জলদস্যুরা মাছ-জলসহ প্রায় ৫ লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুট করে।
২০ আগস্ট রাতে মেঘনা নদী থেকে জলদস্যুরা ৬টি মাছধরা ট্রলার আপহরণ করে। অপহরণকৃত ট্রলারগুলোর জন্য মুক্তিপণ নিয়েও ট্রলার মালিকদেরকে আজ পর্যন্ত তা ফিরিয়ে দেয়নি দস্যুরা।
১১ সেপ্টেম্বর মেঘনার জলদস্যু সম্রাট নাসির কেরানী র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন বলে নাসির কেরানীর পরিবার দাবি করলেও র্যাব তা অস্বীকার করে। এ পর্যন্ত নাসির কেনারীর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তার অনুপস্থিতিতে গ্রুপ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এভাবে নাসির বাহিনীর অত্যাচার থেকে হাতিয়াবাসী কিছুটা শান্তি পেলেও শূণ্যস্থান দখলে নেয় অপর জলদস্যু বাহিনী নিজাম গ্রুপ।
এ ছাড়া জলদস্যুরা এর আগের বছরের ১৪ অক্টোবর ইব্রাহীম সরদার (৫০), কামাল উদ্দিন, আবুল খালেক, বেলাল উদ্দিন, আফছার উদ্দিন, দুলাল উদ্দিন ও রফিক উদ্দিনকে হত্যা করে।
১০ ডিসেম্বর শনিবার গভীর রাতে উপজেলা কালাম চরে জলদস্যুদের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে বহু জলদস্যু নিহত হলেও তাদের লাশ পাওয়া যায়নি। একই দিন উপজেলা চেয়ারম্যান ঘাট সংলগ্ন মেঘনা নদী থেকে অজ্ঞাত পরিচয়ের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। স্থানীয় জেলেরা বলেন, দস্যুরা লাশগুলোর পেট কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে।
১২ ডিসেম্বর হাতিয়া উপজেলায় চাঁদার দাবিতে চর কালামে নিজাম ডাকাত ও তার বাহিনী কৃষকের বাড়িতে হামলা করে হারিছ মাঝি (৩৫), বেলাল মাঝি (৩০) ও খোরশেদ মাঝিকে (৪৫) কুপিয়ে হত্যা করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১২
সম্পাদনা : আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর
বাংলানিউজ স্পেশাল
শাহিন-হাসানকে খুঁজছেন মা, ঘরছাড়া জাহাঙ্গীর-পরিবার
রহমান মাসুদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।