চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও ভোলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এক জনপদ। প্রকৃতির খেয়ালের ওপর ভর করে চলে এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা।
উড়িরচরে দুই বোন জলদস্যুদের হাতে ধর্ষণের শিকার হন একই রাতে এবং তা পরিবারের সবার সামনে। ঘটনার পরদিন তাদের বাবা রাতের আঁধারে জেলেনৌকার সহায়তায় তাদের নিয়ে আসেন সন্দ্বীপের এক জনপ্রতিনিধির কাছে। এখন সেই জনপ্রতিনিধির আশ্রয়েই আছেন তারা। কিন্তু জীবন থেকে মুছে যায়নি সেই বিভীষিকাময় ঘটনার স্মৃতি। পরিবারের আপনজনের সামনেও আর যাওয়া হয়নি লজ্জায়। বিষয়টি প্রকাশ করা হয়নি পারিবারিক ও সমাজিক নিরাপত্তার ভয়ে।
কেবল এই ঘটনাই নয়। এমন ভয়াবহ ঘটনা এখন প্রতিনিয়তই ঘটছে মেঘনাপাড়ের এ চরাঞ্চলে। শুধু এরকম ঘটনা নয়, নাবালিকা মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটাচ্ছে জলদস্যুরা। আর এ কারণে দুধের শিশুদের বিয়ে দিচ্ছেন বাবা-মা। সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে আইনের চোখে হয়ে পড়ছেন দোষী। এ কারণে স্কুলশিক্ষকরা পড়ছেন শিক্ষার্থী সংকটে। ছড়াচ্ছে যৌতুক নামের মহামারী। আখের গোছানোর সুযোগ নিচ্ছেন ইউপি সচিব।
সন্দ্বীপ পৌরসভার মেয়র জাফর উল্লাহ টিটু বলেন, ‘বর্তমানে হরহামেশাই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এ ঘটনা যেন এখন চরের মানুষের কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ’
উড়িরচরের সাবেক ইউপি সদস্য এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি জাহাঙ্গীর মেম্বার বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমার খালাতো ভাই মানিক মেম্বারের ৫ম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়েটিকে গত বছর ধরে নিয়ে গেছে খোকা বাহিনীর প্রধান মাকসুদুল আলম খোকা। কিছুদিন আটকে রাখার পর মেয়েটিকে সে বিয়ে করে এবং এ বছর মেয়েটির কোলে একটি মেয়ে সন্তানও এসেছে। ’
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা চরের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। জলদস্যু বাহিনীর সদস্যরা রাতে এসে হানা দেয় ভূমিহীন পরিবারগুলোর বাড়িতে। রাতের আঁধারে ধরে নিয়ে যায় উঠতি মেয়েদের অথবা নির্যাতন করে যায়। আর এ কারণে কারো ঘরে কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে আঁতকে ওঠে প্রতিটি পরিবার। ’
স্থানীয়রা জানান, আট বছরের বেশি কেউ কন্যাসন্তান ঘরে রাখতে চান না। কিশোর বর জোগাড় করে যৌতুকের বিনিময়ে তার হাতে তুলে দেন শিশু কন্যাকে। যারা একটু প্রভাবশালী বা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে চলেন, তাদের কন্যারা উড়িরচরের বঙ্গবন্ধু জুনিয়র হাইস্কুলে ভর্তি হলেও সপ্তম শ্রেণীতে উঠলেই বিয়ে দিয়ে দেন।
উড়িরচর বঙ্গবন্ধু জুনিয়র হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ হাসান বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ স্কুলের অধিকাংশ মেয়েই ৮ম শ্রেণীতে আসার আগে বাল্যবিবাহের কারণে ঝরে পড়ে। ’
তিনি বলেন, ‘চরের দুঃসহ জীবনে নিজের প্রিয় সন্তানকে দস্যুদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতেই বাধ্য হয়ে অভিভাবকরা মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। ’
হাসান বলেন, ‘যারাও সাহস করে সন্তানদের স্কুলে পাঠায়, তারা সারাক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। স্কুলে আসা মেয়েগুলোও থাকে ভয়ে জড়সড়ো। ’
এসব বিয়ের আইনি বৈধতা দেয় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সচিব বাবুল।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হাসান জানান, স্কুলে নিবন্ধিত জন্ম তারিখ এবং সনদ ফেলে দিয়ে ইউপি সচিব টাকার বিনিময়ে নতুন জন্ম সনদ তৈরি করে দেন বয়স বাড়িয়ে।
কেবল উড়িরচরই নয়। ক্যারিংচরের ভূমিহীন রাজ্জাক সারেং তার মেয়ে লাকিকে তিন বছর আগে মাইজদী গিয়ে তুলে দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের এক অচেনা চাকরিজীবীর হাতে। তিনি আজো জানেন না দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে `পরিচিত সেই অপরিচিতের ঘরে` কেমন আছে আদরের সন্তান।
এ কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন রাজ্জাক সারেং। চারদিক ঘিরে থাকা জলদস্যুর সদস্য এবং চরদের চোখ এড়িয়ে তিনি জানান, লাকির বয়স এখন ১০ বছর হয়েছে। লাকিকে পরের হাতে তুলে দেওয়ার কারণ, তিন বছর আগে মুজিব বাজার এলাকার বাড়িতে রাতের আঁধারে হামলা চালায় দস্যু বাহিনী। তারা সেদিন তার বড় মেয়ে পাখিকে পরিবারের সবার সামনে উপর্যপুরি ধর্ষণ করে অচেতন অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। সকালেই তার মৃত্যু হয়।
রাজ্জাক বলেন, ‘এর এক সপ্তাহ পরই দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করে গার্মেন্টসকর্মী নারায়ণগঞ্জের আব্দুল মোনেমের হাতে তুলে দিই লাকিকে। ’
রাজ্জাক বলেন, ‘আমি একবার নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্মায় গিয়ে মেয়েকে দেখেও এসেছি। কিন্তু পরের বার গিয়ে আর তাদের খুঁজে পাইনি বাসা বদলের কারণে। কিন্তু তাতে দুঃখ নাই। মা আমার যেখানেই থাকুক, জানোয়ারদের হাত থেকে তো রক্ষা পেয়েছে। ’
উড়িরচরের জাহাঙ্গীর মেম্বার বলেন, ‘এ বাল্যবিবাহ দিতে গিয়ে ও যৌতুক জোগাড় করতে সর্বস্বান্ত হয় পরিবারগুলো। ’
তিনি বলেন, ‘ভূমিহীন মানুষগুলো একটি কন্যাকে পাত্রস্থ করতে কমপক্ষে দুই ভরি সোনা এবং লোক খাওয়াতে বাধ্য হন। এ ছাড়া কখনো কখোনো পাত্রকে বিদেশে যেতে টাকাও দিতে হয় যৌতুক হিসেবে। ’
চরের এ রকম হাজারো নির্মম গল্প শোনা যায় সন্দ্বীপ, হাতিয়ার সংবাদকর্মী, এনজিও কর্মী এবং জনপ্রতিনিধিদের কাছে। তাবে তারা কেউই নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তার ভয়ে কারো কাছে মুখ খোলেন না। তবে তারা শুধু একটি কথাই বলেন, ‘ভাই এ যেন বাংলা সিনেমা। ’
বাংলাদেশ সময় : ১৫০০ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১২
সম্পাদনা : আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর