ঢাকা: আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের আমলে দেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আর্থিক খাত। ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে টাকা নিয়ে তা ফেরত না দিয়ে পাচারের ফলে বেশ কিছু ব্যাংক মারাত্মক সংকটে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, শেখ হাসিনার শাসনামলে ২০১৭ সালের পর যেসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে তা পর্যায়ক্রমে খেলাপি হয়ে পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে এ ঋণ খেলাপি হলেও খেলাপি হিসাবে না দেখিয়ে গোপন করে রাখা হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলে। তখন দেখানো হচ্ছিল ১২ শতাংশের মধ্যে রয়েছে খেলাপি ঋণ। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নিলেই আসল বিষয়টি বেরিয়ে আসে। এ বছরের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বরের হিসাবে দেখা যায়, ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ।
এ বিষয়ের বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ২৫-৩০ শতাংশে পৌঁছে যাবে। এসব ঋণের বড় অংশ ২০১৭ সালের পর দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঋণ তদারকি জোরদার করেছে। ঋণ কেলেঙ্কারি ও খেলাপি ঋণে ন্যুব্জ ব্যাংকিং খাত সংস্কারে গত সেপ্টেম্বরে ছয় সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন কোনো ঋণ খেলাপি হলে কোনো প্রভাবের বলে খেলাপি দেখানো থেকে বিরত রাখতে পারছে না কেউ গ্রহীতারা। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সমন্বিত নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে মোতাবেক টাস্ক ফোর্সের অধীনে আন্তর্জাতিক তিনটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান পরীক্ষা শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক এসব প্রতিষ্ঠান প্রথমে ১২টি ব্যাংক ও পরে ২০ ব্যাংকে নিরীক্ষা করবে। এতে প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসবে বলে আশাবাদী কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, জানুয়ারি মাসেই জানা যাবে দুর্বল ব্যাংকগুলোর প্রকৃত চিত্র। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কোনো ব্যাংক মার্জ (সবল ব্যাংকে একীভূত) হবে, নাকি অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ইতিবাচক উদ্যোগ বলছেন অর্থনীতিবিদরা
ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের ক্ষত মেরামতের এ উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, এ ধরনের উদ্যোগ-চাঞ্চল্য আশাব্যঞ্জক।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, প্রথমত, ব্যাংকের যে সমস্যা আছে সেটা স্বীকার করা, দ্বিতীয়ত শনাক্ত করা এবং সমস্যাগুলো মোকাবিলার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয় স্বীকার করা হয়েছে। এটা ইতিবাচক খবর। কিন্তু এটা করতে সময় লাগবে। এই সমস্যা একদিনে সৃষ্টি হয়নি, আবার একদিনে সমাধানও হয়ে যাবে না।
তিনি বলেন, আর্থিক খাতের যে ক্ষত, সেখানে অনেক দিক আছে। এসব ক্ষত সারতে সময় লাগবে। কিন্তু সমস্যা যে আছে এবং সমাধানের পথ খুঁজতে হবে—এই যে আমাদের রিয়ালাইজেশন (উপলব্ধি) হয়েছে, এটাই একটা পদক্ষেপ। যে ক্রমবর্ধমান ঋণ খেলাপি, বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে খেলাপি ঋণের হার ৩০ শতাংশ হয়ে যেতে পারে; এটা একটি বড় সমস্যা। এজন্য দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কীভাবে সচল করা যায়, ব্যবস্থাপক দিয়ে ঠিক করতে হবে নাকি একীভূত (মার্জ) করা হবে, নিয়ম-কানুনসহ এগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান পরামর্শ দিয়ে বলেন, খেলাপি ঋণ ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত এগুলো ভাগ করে কীভাবে নিয়মিত করতে পারি—এটা একটি দিক। সামনের দিকে বিভিন্ন ধরনের রক্ষাকবচ রাখতে পারি, যাতে এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। যে টাকা দেশের বাইরে গেছে সে টাকা কীভাবে ফেরত আনা যায়, সেটা সম্পর্কেও উদ্যোগ নিতে হবে। সুতরাং এ রকম চারদিক থেকে আমরা উদ্যোগ, উদ্যম ও চাঞ্চল্য দেখছি। এটা আশাব্যঞ্জক।
আর্থিক খাতে এত সমস্যা, আগে এটা স্বীকারই করা হতো না উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, এখন সমস্যা স্বীকার করে কিছু কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আবার এগুলো স্বল্পমেয়াদে ফল দেবে, এমনও মনে করি না। এগুলোর জন্য সময় লাগবে। সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা ও সেটার মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা, এগুলোর মধ্যে স্বস্তির জায়গা নেওয়া—এসব মিলিয়ে বিষয়টাকে দেখতে হবে।
১৬৭০ কোটি ডলার লোপাট
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্রের তথ্য মতে, আওয়ামী লীগ আমলে ব্যাংক দখলে নেওয়ার পর নতুন শেয়ার হোল্ডারদের ঋণ দেওয়া এবং আমদানি চালানে অতি মূল্যায়নের মাধ্যমে আনুমানিক এক হাজার ৬৭০ কোটি ডলার (প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা) লুট করা হয়েছে, যার পুরো টাকাই বিদেশে পাচার হয়েছে। বিশ্বের আর কোথাও এই খাতে এত লুটপাটের ঘটনা ঘটেনি এবং যার পেছনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছিল।
বিপুল অর্থ পাচার হওয়ার ফলে ১০টি ব্যাংক প্রায় দেউলিয়া হয়ে বসে আছে। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, পদ্মা ব্যাংক, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বেসিক ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকসহ ১০ বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৪০ শতাংশ থেকে প্রায় ৯০ শতাংই খেলাপি ঋণ। এসব ব্যাংকের মধ্যে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক বাদে বাকি সবগুলোই আওয়ামী লীগ সরকারের সময় লুটপাটের শিকার হয়।
খেলাপি ঋণের ভারে ন্যুব্জ এসব ব্যাংক নামমাত্র চালু থাকলেও কার্যত ব্যাংকিং করার ক্ষমতা হারিয়েছে। এসব ব্যাংকের ৯০ শতাংশই হারিয়েছে নতুন করে ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা। এর মধ্যে সাতটি ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিত নগদ সহায়তা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী, এক্সিম ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংককে বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের সময়েই ২২ হাজার ৫০০ কোটি ধার দেওয়া হয়েছে।
তারপরও ব্যাংকগুলো গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়ার চাপ সামাল দিতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এসব ব্যাংকে থাকা আমানতের নিশ্চয়তা দেওয়া হলেও গ্রাহকদের আতঙ্ক কাটছে না। তারা প্রতিদিনই ব্যাংকে ভিড় করছেন আমানত তুলতে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০২৪
জেডএ/এইচএ/