শ্রীমঙ্গল: বৃক্ষরোপণ মানুষের বিশেষ একটি শখ। এতে মানুষ ও প্রকৃতি থাকে কাছাকাছি।
তবে অনেকেই না বুঝে, না জেনে এমন গাছ লাগান যা আমাদের মাটি ও পরিবেশের জন্য একেবারেই উপযোগী নয়। বরং অন্য গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। শুধু তা-ই নয়, দ্রুত নগদ অর্থলাভের আশায় মানুষ ক্ষতিকর গাছটি কেউ কেউ রোপণ করেন।
এমনই একটি বহুল রোপিত গাছের নাম ইউক্যালিপটাস। এটি আমাদের দেশীয় কোনো গাছ নয়। আদিবাস অস্ট্রেলিয়ায়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এ গাছের গুরুত্ব নেই বললেই চলে। আমাদের দেশি গাছের মতো প্রাকৃতিক উপকারি গাছ সে নয়। বেশ কয়েক বছর যাবত আমাদের বসতবাড়ি, রাস্তার দু’পাশ, জমির আইল, ফলের বাগান প্রভৃতি স্থানে এ গাছ লাগিয়ে পরিবেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
৫ থেকে ১০ বছর বয়সী একটি ইউক্যালিপটাস গাছ বছরে ৫০০-১০০০ মিলিলিটার পানি শোষণ করে। আমাদের দেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলোতে এই গাছ লাগানো নিষিদ্ধ। টিউবওয়েল বা কুয়োর আশপাশে ইউক্যালিপটাস গাছ থাকলে অনেক ক্ষেত্রে টিওবওয়ের পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যায় এবং কুয়ার পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যায়। এই গাছ মাটিকে পানিশূন্য ও অনুর্বর করে ফেলে। বিশ-ত্রিশ বছর কোনো স্থানে গাছগুলো থাকলে সেখানে অন্য প্রজাতির কোনো গাছ জন্মাতে পারে না।
যে দেশের অধিকাংশ ছিন্নমূল মানুষসহ নিম্নমধ্যবিত্ত মারাত্মকভাবে ক্ষুধা-অপুষ্টিতে জর্জরিত এবং যে দেশে প্রচুর পুষ্টি চাহিদা রয়েছে, যে দেশে পুষ্টিকর ফলজ গাছ রোপণ না করে পরিবেশ ধ্বংসকারী এসব গাছ লাগনো বিবেচনাপ্রসূত নয়। গাছটি কোনো ক্রমেই আমাদের দেশোপযোগী নয়।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়- বৃক্ষপ্রেমী সাধারণ মানুষের উপর একসময় ইউক্যালিপটাস চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিলো ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না দিয়েই। বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর, রংপুর প্রভৃতি অঞ্চলগুলোতে এ গাছের প্রথম প্রচলন ঘটনা হয়।
অপরদিকে আমাদের দেশের নানা প্রজাতির অত্যন্ত সুস্বাদু ফলজ গাছ অর্থাৎ, আম, কাঁঠাল, জাম, জামরুল, নারিকেল প্রভৃতি গাছ পুষ্টি চাহিদা পূরণই শুধু নয়– অর্থনৈতিকভাবেও অত্যন্ত লাভজনক। সবচেয়ে বড় কথা পরিবেশবান্ধব এই দেশি বৃক্ষ রোপণ করার ফলেই আমাদের চারপাশের বিপন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ তার নিসর্গময় ভারসাম্যকে ফিরে পেতে পারে। তাই আমাদের বারবার পরিবেশ ও প্রকৃতির কথা চিন্তা করে আমাদের বাড়ির পরিত্যক্ত জায়গায় নূন্যতম একটি দেশি ফলজ গাছ রোপণ করতে হবে।
ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম এ রহিম বাংলানিউজকে বলেন, ইউক্যালিপটাস জিরোপেট্রিক ন্যাচারের গাছ। বিধায় সে মাটির গভীর থেকে পানি শোষণ বেশি করে। এটি দ্রুত বর্ধনশীল। গাছটি ১৫/২০ বছর কোনো স্থানে থাকলে সেখানে অপর প্রজাতির কোনো গাছ জন্মাতে অসুবিধার সৃষ্টি করে। কারণ পাতার টক্সিক কেমিক্যাল মাটিতে থাকা নাইট্রোজেন পরমাণু ভেঙে দিয়ে ছোট ছোট উদ্ভিদের খাদ্য তৈরির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করে। এতে মাটির পুষ্টি-প্রবাহও নষ্ট হয়।
অধ্যাপক রহিম আরও বলেন, এখন তো দেশি ফলের গাছগুলো একে এক নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। বেল, আমড়া, আতা, জলপাই, খেজুর, জামরুল, গোলাপ জাম, লটকন, কাজু বাদাম প্রভৃতি এখন আর চোখেই পড়ে না। আজ থেকে দশ-পনের বছর আগেও গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই এসব একাধিক দেশীয় ফলের গাছ ছিলো। ক্ষতিকর ইউক্যালিপটাস গাছ না লাগিয়ে আমাদের দেশের সুস্বাদু ফলের গাছ রোপণ করা এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ড. এম এ রহিম আরও বলেন, ফল গাছ উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা এখন ব্যাপকভাবে নানা জাতের ফলের গাছ ছড়িয়ে দিয়েছি। ফলে দেখা যাচ্ছে ইউক্যালিপটাসসহ অন্যান্য ক্ষতিকর গাছ বাদ দিয়ে মানুষ এখন ফল গাছের দিকে ঝুকছে বেশি। আমরা উন্নত জাতের আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লেবু, লিচু, কদবেল প্রভৃতির চারা বিতরণ করছি। ফল গাছ আমাদের ছায়া দেবে, ফল দেবে, আশ্রয় দেবে, দেবে- সর্বপরি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দেবে। মানুষ এখন ব্যাপকভাবে এসব ফলের গাছ লাগাচ্ছেন। এটিই একমাত্র আশার কথা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১০ ঘণ্টা, জুন ০৫, ২০১৫
এএ/