ঢাকা: স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এতে বাজার সয়লাব। রমজান উপলক্ষে এর ব্যবহার আরও বেড়ে গেছে।
ইফতার সামগ্রীসহ অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য পলিথিন ব্যাগের মাধ্যমে রোজাদারদের হাতে তুলে দিচ্ছেন দোকানিরা। এছাড়া অভিজাত রেস্টুরেন্ট, মুদির দোকান, কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে ফুটপাতের প্রায় সব দোকানের পণ্য বহনে ব্যবহৃত হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ।
এমন এলাকা পাওয়া দুষ্কর, যেখানে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নেই। ক্ষতিকর ও নিষিদ্ধ এ পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে বাজারে প্রায়ই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। কিন্তু তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা।
রাজধানীর শান্তিনগর, মালিবাগ, কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুরসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, পলিথিন ব্যাগে করে অধিকাংশ পণ্য-দ্রব্য ভোক্তাদের কাছে তুলে দিচ্ছেন বিক্রেতারা। এমনকি বাজারের ভিতরেই লোকচক্ষুর সামনে অন্য পণ্যের সঙ্গে পলিথিন ব্যাগও বিক্রি হচ্ছে দেদারছে।
মালিবাগ বাজারের মুদি দোকানদার হাসান মুন্সী ও মোহাম্মদপুরের ফয়েজ আলী জানান, কয়েক বছর আগে পলিথিনের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালানো হতো। এখন তা কমে গেছে। তবে মাঝে মধ্যে প্রশাসনের লোকেরা বাজারে এলে পলিথিন লুকিয়ে রাখা হয়।
পরিবেশবিদরা মনে করেন, পলিথিন প্রস্তুতকারী কারখানায় উৎপাদন বন্ধ না করে শুধু বাজারে ভ্রাম্যমাণ অভিযান চালানোর মাধ্যমে এটি বন্ধ করা সম্ভব নয়। বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগের ব্যবহার ও উৎপাদন বাড়ানো দরকার।
পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, ২০০২ সালে আইন করে পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। কিন্তু এ আইন বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে।
তাদের আরও অভিযোগ, বাজারে পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে নিয়মিত মনিটরিং নেই। এ কারণে অসাধু পলিথিন ব্যাগ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলাশহরে দেদারছে উৎপাদন করছে অপচনশীল এসব ব্যাগ। আর তা বাজারজাতকরণের মাধ্যমে দোকানদার হয়ে সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে, ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি পলিথিন নষ্ট করছে পরিবেশ।
নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ না হওয়ার জন্য আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা না থাকা, সরকারের সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবকে দায়ী করছে পরিবেশবাদীরা।
স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও পরিবেশবাদীদের মতে, পলিথিন অপচনশীল পদার্থ হওয়ায় দীর্ঘদিন প্রকৃতিতে অবিকৃত অবস্থায় থেকে মাটিতে সূর্যালোক, পানি ও অন্যান্য উপাদান প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। পচে না বলে মাটির উর্বরতা শক্তি কমে যায় ও উপকারী ব্যাকটেরিয়া বিস্তারে বাধা তৈরি করে।
এছাড়া পলিথিন মোড়ানো গরম খাবার খেলে মানুষের ক্যান্সার ও চর্মরোগের সংক্রমণ হতে পারে। পলিথিনে মাছ ও মাংস প্যাকিং করলে তাতে অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হয়, যা দ্রুত পচনে সহায়তা করে।
অন্যদিকে, উজ্জ্বল রঙের পলিথিনে রয়েছে সীসা ও ক্যাডমিয়াম, যার সংস্পর্শে শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত ও চর্মপ্রদাহের সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (২০০২ সালের ৯ নম্বর আইন দ্বারা সংশোধিত) এর ৬ক ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার সব বা যেকোনো প্রকার পলিথিন শপিং ব্যাগ, বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরি অন্য কোনো সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলে, এরূপ সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন বাংলানিউজকে বলেন, পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে যে আইন করা হয়েছে তা ভালো উদ্যোগ। এ আইন হওয়ার পর গত ১৩ থেকে ১৪ বছর বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু এসময় ক্ষমতায় থাকা কোনো সরকারই এ আইন বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখায়নি। যে কারণে আইনি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, ক্ষতিকর পলিথিন পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। এজন্য ওই আইনের বাস্তবায়ন দরকার। শুধু ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলেই হবে না, যেখানে পলিথিন ব্যাগ প্রস্তুত হয়, সেসব কারখানার উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হবে।
সম্প্রতি অবসরে যাওয়া পরিবেশ অধিদফতরের (সাবেক) অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. শাহজাহান বাংলানিউজকে বলেন, পলিথিন ব্যবহার করে মাটিতে ফেলে দিলে নিঃসন্দেহে পরিবেশের জন্য ভয়াবহ ক্ষতি হবে। এজন্য এ নিয়ে আইনও করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে পলিথিনের পুনরায় ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও পুনরায় ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে পারে।
অপচনশীল দ্রব্যবহনে বিকল্প হিসেবে পাটের তৈরি শপিং ব্যাগের ব্যবহার বাড়ালে, পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার কমে আসবে বলে মনে করেন সাবেক এ পরিবেশ কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৩ ঘণ্টা, জুলাই ০৭, ২০১৫
টিএইচ/এসএস