শ্রীমঙ্গল: বর্ষা মানেই প্রাণবৈচিত্র্য। প্রতিটি বৃষ্টিফোঁটার আলতো পরশে প্রকৃতি পায় নবপ্রাণের স্পন্দন।
বাংলার গ্রামীণ প্রকৃতিতে যে জলাশয়গুলো বছরের পর বছর ধরে চারপাশের মানুষের সীমাহীন উপকার সাধারণ করে চলেছে এই অশান্ত বর্ষায় সেই জলাধারগুলোও ফিরে পায় তার নবযৌবন। অনেক জলচর পাখির মতো ডাহুকও সেখানে তার ভালোবাসার সঙ্গী নিয়ে ছুটে বেড়ায় এদিক-ওদিক। নির্জন জলজ প্রান্তর ভরে ওঠে ভালোবাসামুখর।
শাপলা-পদ্মের প্রতিটি মেলে থাকা পাতা সাক্ষী রেখে একসময় তারা সংসার পাতে। বর্ষা মৌসুমে হাইল হাওর ও বাইক্কা বিলে ডাহুকের দৌড়ঝাঁপ দেখে বহুদিন মুগ্ধ হয়েছি। আগ্রহীরা ডাহুকের সৌন্দর্য দেখতে এই বর্ষা মৌসুমেই আপন এলাকার জলাশয়ের দিকে নজর রাখতে পারেন।
ডাহুকের ইংরেজি নাম White Breasted Waterhen এবং বৈজ্ঞানিক নাম Amaurornis phoenicurus। ধলাবুক ডাহুক ও পান-পায়রা নামেও এর পরিচিতি রয়েছে। এরা প্রচণ্ড লড়াকু ধরনের পাখি। প্রজননের সময় একটি পুরুষ ডাহুক অন্য একটি পুরুষ ডাহুককে সহ্য করতে পারে না। দেখলেই লড়াই বাঁধিয়ে দেয়।
ডাহুক আমাদের দেশের সুলভ আবাসিক পাখি। এরা প্রচণ্ড গতিতে ছুটতে পারে। দৈর্ঘ্য ৩২ সেমি. ও ওজন ১৯০ গ্রাম। এদের পিঠের দিক কালচে ও দেহের নিচের দিক সাদা। পুরো ঠোঁট হলদে সবুজ হলেও এর উপরের অংশ লাল।
ডাহুকের খাদ্যতালিকায় রয়েছে জলজ উদ্ভিদ ও কীটপতঙ্গ। অর্থাৎ শাপলা-পদ্ম ফুলের নরম অংশ, কচি পানিফল, জলজ শেওলা, লতাগুল্মের নরম অংশ, ধান, কাউন, ডাল, সর্ষে, শামুক, কেঁচো, জোঁক, মাছ, ছোট মাছ প্রভৃতি।
তবে সত্যিই অস্তিত্ব সংকটে আজ ওরা! প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো মানুষের দখলে চলে আসার কারণে অন্যান্য জলচর পাখির মতো অনেকটাই বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে ডাহুক।
সারাদেশের প্রাকৃতিক জলাভূমিগুলো বেদখল হচ্ছে ধীরে ধীরে। প্রাকৃতিক হাওর-বিলগুলোর এই দখলবাজি প্রতিবেশ ও প্রাণিবৈচিত্র্যকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে জলাভূমি ঘিরে বেড়ে ওঠা জলজ উদ্ভিদসহ ঝোঁপ-ঝাড়গুলো। অধিকাংশ জলাভূমিতে এখন চলছে মাছের খামার করার প্রাকৃতিক পরিবেশধ্বংসকারী প্রতিযোগিতা।
ডাহুক সম্পর্কে জানতে বাংলাদেশের বরেণ্য পাখি গবেষক ও লেখক শরীফ খানের মুখোমুখি হলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এককালে গ্রামবাংলায় প্রচুর পরিমাণে ডাহুক দেখা যেত। চল্লিশ-পঞ্চশ বছর আগে প্রত্যেক গ্রামেই দু-চার-পাঁচ জোড়া ছিল। এখন আর গ্রামাঞ্চলের ডোবা-জলাশয়ে এখন আর দেখা যায় না।
তিনি আরও বলেন, পোষা ডাহুকের পাশাপাশি বুনো ডাহুকও ছিল অনেক। এর প্রধান কারণ তাদের বিচরণভূমি ও আবাসস্থল ধ্বংস। ওরা যে গোপন জায়গায় বাসা বাঁধবে এমন গোপন জায়গা অর্থাৎ ঝোঁপঝাড় এখন আর নেই। এদের খাবার সংকট না থাকলেও মারাত্মক নিরাপত্তার সংকট রয়েছে। এরা যে নিরিবিলি থাকবে সে অবস্থা আর নেই!
শরীফ খান বলেন, সারা বছর চুপচাপ থাকলেও বর্ষা মৌসুমে কুক্ কুক্ ডাকা-ডাকিতে বাসার চারপাশ মুখরিত করে তোলে। ওদের গলার স্বর বেশ চড়া। ডাহুকরা বেশি ডাকতো বাসা বেঁধে ডিম পাড়ার জন্য। রাতভর একটানা ডাকতো। মনে হতো ওরা হয়তো দুঃখে বিলাপ করছে।
তিনি আরও বলেন, বর্ষায় এদের বেশি দেখা যায়। ঘন ঝোঁপ-ঝাড়ের ভেতর বাসা করে মূলত এ সময়ই। ডিম পাড়ে ছয়টি থেকে সাতটি। একুশ থেকে চব্বিশ দিন পর ছানা বের হয়। ছানাগুলো হয় কুচকুচে কালো বর্ণের।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৪ ঘণ্টা, জুলাই ০৭, ২০১৫
বিবিবি/এএ