ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

খসে পড়া লেজেই শত্রুর নিপাত (ভিডিওসহ)

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, এনভায়রনমেন্ট স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪৩ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৫
খসে পড়া লেজেই শত্রুর নিপাত (ভিডিওসহ) ছবি: সংগৃহীত

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষার একমাত্র কৌশলটি রয়েছে লেজেই। বিপদ যখন এগিয়ে এসে তার শরীর স্পর্শ করে, তখন লেজটি হালকা আঘাতে তার শরীর থেকে নিচে খসে পড়ে।

তারপর শুরু করে দ্রুত নড়াচড়া! যেন দারুণ এক নৃত্যশৈলী। লেজেই রয়েছে তার বিভ্রান্তির এমন অনবদ্য আকর্ষণ।

খসে পড়া লেজটি এতোটাই দ্রুতগতিতে নড়তে থাকে যে শত্রুপক্ষও গোলকধাঁধায় পড়ে যায়।

শত্রুর মনোযোগ তখন ওই পরিত্যক্ত লেজটির দিকে। অতি আগ্রহে সে তখন প্রত্যক্ষ করতে থাকে ওই লেজের দারুণ নাচন। ব্যাস, এই ফাঁকে লেজবিহীন টিকটিকি দেয় চম্পট! প্রকৃতিপ্রদত্ত নিজেকে রক্ষার এ এক দারুণ কৌশল! যা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে যুগ যুগ ধরে।     

টিকটিকি লেজ হারানোর কয়েকদিনের মাথায় আবার তার লেজটি স্বাভাবিকভাবে গজিয়ে যায়। নতুন গজানো লেজটি নিয়ে সে তখন ঘোরাঘুরি করতে পারে। প্রয়োজনে আবারও লেজটিকে বিসর্জন দিয়ে আত্মরক্ষা করে। সৃষ্টির এ এক দারুণ রহস্য - অবাক বিস্ময়ে তা লক্ষ্য করি।
 
আমাদের বাড়িতে একই ছাদের নিচে বসবাস করা বিচিত্র এ প্রাণীটির নাম টিকটিকি। ইংরেজিতে বলে Common House Lizard এবং বৈজ্ঞানিক নাম Hemidactylus frenatus
 
তবে এরা মাতৃস্নেহসম্পূর্ণা নয়। নিজের সন্তানদের নিয়ে এরা কখনও ঘুরে বেড়ায় না। প্রকৃতিগতভাবেই এরা সন্তানবঞ্চিত প্রাণী। তাদের সন্তান কোনটি তা স্ত্রী বা পুরুষ টিকটিকি জানে না। আর সন্তানটিও শনাক্ত করতে পারে না কে তার বাবা-মা। যেখানে-সেখানে ডিম পেড়ে রেখেই মা টিকটিকি উধাও হয়ে যায়। ডিমটির প্রতি কিংবা পরবর্তীতে ছানাটির প্রতি কোনো প্রকার নজরদারি আর থাকে না মা টিকটিকির।    

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও প্রখ্যাত বন্যপ্রাণি বিশেষজ্ঞ ড. মনিরুল খান এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, টিকটিকি সরীসৃপ জাতীয় অমেরুদণ্ডী প্রাণী। এরা মানুষের বসতি বা মানুষের আশপাশে বেশি থাকে। অন্য প্রাণীদের মতো এদের মাঝে ‘প্যারেনটাল কেয়ার’ অর্থাৎ পিতৃমাতৃ স্নেহমমতা দেখা যায় না। এরা শুধু জায়গামতো ডিম পেড়ে রাখে। পরে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।

তিনি আরও বলেন, তাদের পায়ের গঠনের জন্য এরা অনায়াসের মসৃণ খাঁড়া দেয়ালে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেলা করতে পারে। এরা যখন পা ফেলে তখন পায়ের নিচে বায়ুশূন্য হয়ে যায় এবং পা দেয়ালে আটকে থাকে। টিকটিকি সাধারণত আট থেকে পনেরো সেন্টিমিটার লম্বা হয়। এদের ওজন প্রায় পঞ্চশ থেকে একশত গ্রাম। এরা প্রায় পাঁচ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।

ড. মনিরুল খান আরও বলেন, টিকটিকির রক্ত কিন্তু সাদা হয়। আমাদের রক্ত কেমন হবে তা নির্ভর করে রক্তের উপাদানের উপর। রক্তের রয়েছে তিনটি উপদান: শ্বেতকণিকা, লোহিতকণিকা আর অণুচক্রিকা। টিকটিকির রক্তে শ্বেতকণিকা বেশি থাকার ফলে সাদা হয়। আর আমাদের রক্তে লোহিতকণিকার পরিমাণ বেশি থাকে বলে এটি লাল হয়ে থাকে।
 
আমার ডেক্সটপ কম্পিউটারের ঠিক পেছনে দু’টি টিকটিকির বসবাস। একটির রং কিছুটা হালকা কালো অপরটি হালকা বাদামি। অনেক দিন ধরেই তারা বসবাস করছে আমার পাশে। তাদের শিকার ধরার কৌশলটি নীরবে উপভোগ করি। কী দ্রুতগতিময় তার জিহ্বার গতি! ছোট ছোট পোকা বা পতঙ্গকে তারা আস্ত গিয়ে খায়। এক সেকেন্ডের তিনভাগের একভাগ সময়ের মধ্যে সে ওই গিলে খাবার পর্বটি সমাপ্ত করে।

আমাদের কথা বলার সময় হঠাৎ করে কোনো টিকটিকি ‘টিক-টিক’ করে ডেকে উঠলেই আমাদের অনেকেই ওই ডাকটিকে দৈনন্দিন জীবনের অনেক শুভ-অশুভ বা সত্য-মিথ্যার প্রমাণ বা বিচারক হিসেবে ধরে থাকেন। আসলে এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই। কারণ এটি সম্পূর্ণভাবে একপ্রকারের কুসংস্কার।
 
অনেকে আবার এই টিকটিকিকে নিজের ঘরে দেখতে রাজি হন না। কিন্তু তারা অত্যন্ত নিরীহ ও নীরব উপকারী একটি প্রাণী। টিকটিকি ক্ষতিকর পোকা-পতঙ্গ খেয়ে ঘরের পরিবেশ স্বাভাবিক রাখে। অনেকে টিকটিকির ডিমকে আবার ছুড়ে ফেলে দেন। দয়া করে এমনটি করবেন না। বরং ওই ডিমটিকে সতর্কতার সঙ্গে তুলে নিয়ে নিরাপদ স্থানে রেখে দিন।

কয়েকদিন পরই দেখতে পাবেন - ওই ডিম থেকে জন্ম হবে একটি নতুন প্রাণের। হোক না সে ক্ষুদ্র সরীসৃপ! তবুও আমাদের সঙ্গে বসবাসকারী এই গ্রহেরই বাসিন্দা সে। আপনার হাত দিয়ে বেঁচে যাওয়া ওই শিশু সরীসৃপটির মূল্য কম নয়। সেও যে ঘরের ক্ষতিকর পোকামাড়ক নিধনে বদ্ধ পরিকর।  



বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৫ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৫
বিবিবি/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।