ময়মনসিংহ: ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে উত্তর-পশ্চিমে নির্জন চর। এক সময় এ চরেই দেখা মিলতো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী শকুনের।
শুধু ময়মনসিংহই নয়, গোটা দেশেই এখন শকুনের দেখা মেলা ভার। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে এখনো টিকে আছে বাংলা ও সরুঠোঁট প্রজাতির শকুন। আশার খবর হচ্ছে, ‘প্রকৃতির ঝাড়ুদার’ এ প্রাণীর প্রজনন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাচ্চা ফোটানোসহ নিরাপদ আবাসের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। সুস্থ ও নির্মল পরিবেশ নিশ্চিত করতেই নেওয়া হয়েছে এ উদ্যোগ।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি অনুষদের এক সেমিনারে গবেষকরা এ তথ্য জানিয়েছেন।
বুধবার (২৮ অক্টোবর) রাতে ‘সেভ ড্রাগ অ্যান্ড ভালচার কনজারভেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের মেডিসিন বিভাগের গ্যালারিতে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এর আয়োজন করে।
জানা গেছে, আশির দশকে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার পোড়াকান্দুলিয়া বাজারের পশ্চিমে হাটের দিনে আকাশ কালো করে দলবেঁধে আসতো শকুনের ঝাঁক। কংশ নদে ভেসে যাওয়া লাশের ওপর ভেসে চলতো ধূসর শকুন। গরু মহালের আকাশে ছায়া ফেলে চক্কর দিতো শকুন-শকুনিরা।
ময়মনসিংহ অঞ্চলে এক সময় আকাশের দিকে তাকালেই শকুন আর শঙ্খচিলের দেখা মেলতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় ময়মনসিংহ সীমান্তে নেতাই ও সোমেশ্বরী নদীতে ভেসে যেতো লাশের পর লাশ। শিববাড়ি ওয়েনজেসি শরণার্থী শিবিরে প্রতিদিন অসংখ্য লোককে হত্যা করা হতো।
সেসব লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হতো নদীতে। নেত্রকোনার দুর্গাপুরের শীতলী বিল ভরে গিয়েছিল লাশে। সে সময় লাশের সঙ্গে এ এলাকায় বাড়তে থাকে শকুনের সংখ্যা। লাশের পাশে অবস্থান নিয়ে থাকতো পরিবেশবান্ধব এ পাখিটি।
প্রখর দৃষ্টিশক্তির অধিকারী পাখিটি বটগাছ, কড়ইগাছ, শিমুল, বাঁশঝাড়, দেবদারু গাছে বাসা গড়তো। এদের দৃষ্টি এতোটাই প্রখর যে, অনেক উঁচু থেকেও এরা মাটি বা পানির ওপরে থাকা লাশ দেখতে পায়।
গবেষকরা জানান, এ প্রাণী মৃত পশু-পাখি খেয়ে পরিবেশ দূষণ কমায়। একই সঙ্গে অ্যানথ্রাক্সসহ বিভিন্ন রোগের জীবাণু ছড়ানোর হাত থেকেও পরিবেশকে রক্ষা করে। এ কারণে একে বলা হয় ‘প্রকৃতির ঝাড়ুদার’।
গোটা পৃথিবীতে ২৩ প্রজাতির শকুন থাকলেও বাংলাদেশে দেখা যায় মাত্র ৭ প্রজাতির। বর্তমানে দেশে এ প্রাণিটি বিলুপ্তপ্রায়। ভারতে বর্তমানে ১০ হাজারের বেশি শকুন বাস করলেও এ দেশে মাত্র ২৫০টি শকুন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
আয়োজকরা শকুনের বিলুপ্তির পেছনে গবাদিপশুর ব্যথানাশক ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ওষুধকে দায়ী করলেও ভেটেরিনারি অনুষদের একাধিক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক এটি মানতে নারাজ। তারা শকুন হ্রাসের জন্য খাদ্য সঙ্কট, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।
আয়োজকরা বলেন, ২০১০ সালে গবাদিপশুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ওষুধের ব্যবহার সরকার নিষিদ্ধ করলেও প্রায় ৬৮ শতাংশ ক্ষেত্রে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। শকুনের জন্য ক্ষতিকর কিটোপ্রোপিন ওষুধের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার দাবি জানান তারা।
আর হারাবে না শকুন, এমন আশাবাদী উচ্চারণ করে গবেষকরা বলেন, সিলেট, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের ১৯৬৬৩ বর্গকিলোমিটার এবং খুলনা, ঢাকা ও বরিশাল বিভাগের ২৭৭১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা শকুনের জন্য অভয়ারণ্য ও নিরাপদ বসবাসের এলাকা করা হয়েছে। শকুনের প্রজনন বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বাচ্চা ফোটানোসহ নিরাপদ আবাসের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ভেটেরিনারি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সামাদ। এতে প্রধান প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলী আকবর। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের পাখি গবেষণা প্রকল্পের প্রধান ইনাম আল হক, আইইউসিএন’র বাংলাদেশ অফিসের প্রকল্প পরিচালক ড. হাসিব মো. ইরফানুল্লাহ, ময়মনসিংহ জেলা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা গোবিন্দ রায়।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইইউসিএন’র বাংলাদেশে শকুন রক্ষা বিষয়ক প্রকল্পের প্রধান গবেষক এবিএম সরোয়ার আলম এবং বাকৃবির সার্জারি ও অবস্ট্রেট্রিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল আলম।
বাংলাদেশ সময়: ০৭০৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৫
আরএম/এএসআর