শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): একমাস আগেও কিছুই ছিল না তাদের। না ছিল স্বপ্ন, না কাজ।
শ্রীমঙ্গলে কুচিয়া গবেষণা প্রকল্পের এ পরীক্ষামূলক খামারটি তাদের হাতেই লালিত। দৈনিক যত্নআত্তির মমতাময়ী স্পর্শে বেড়ে বেড়ে উঠছে কুচিয়াগুলো (Amphipnous Cuchia)।
একসময় আমাদের দেশের হাওর, বিল, ডোবাসহ প্রকৃতিক নানা জলাশয়ে প্রচুর সংখ্যক কুচিয়া পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে এসব প্রাকৃতিক জলাভূমিগুলো দূষিত ও বিনষ্ট হওয়ার কারণে এ মাছের সহজলভ্যতা ক্রমে হারিয়ে গেছে।
বারো সদস্যবিশিষ্ট এ দলের নেতার নাম রশিদ দুষাদ। তার বাড়ি উঠানের একপাশে চাষ করা হচ্ছে কুচিয়া।
কুচিয়া ধরা খুব সহজ কাজ নয়। ছবির জন্য অপেক্ষা করতে হলো পাক্কা দু’দিন।
পুকুরে নেমে মাছগুলো ধরতে ধরতে হতাশার কণ্ঠে রশিদ বলেন, প্রায় একমাস হবে আমি তাদের সঙ্গে আছি। প্রতি মুহূর্ত দেখাশোনা করি। মরতে দেখলে আমার খুবই কষ্ট লাগে। তবে এ পর্যন্ত ৬/৭টি কুচিয়া মুখে ঘা হয়ে মারা গেছে। আমাদের সম্পূর্ণভাবে সহযোগিতা করে চলেছে উপজেলা মৎস্য অফিস।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে রশিদ বলেন, দিনে কুচিয়াগুলো কুলপাড়ে (পুকুরের মধ্যে তৈরি করা পাড়) থাকে এবং রাতের বেলা নিচে নেমে খাবার খায়। কুচিয়া আমাদের খুবই প্রিয় খাবার।
আমাদের দলে আমি ছাড়া রয়েছে গোপাল দুষাদ, গোপেশ সাঁওতাল, জয়রাম রিকিয়াশন, ছবিলাল রিকিয়াশন, জগন্নাথ সাঁওতাল, সবুজ হাজরা, সৎনারায়ণ রবিদাস, শান্তি দুষাদ, নমি দুষাদ, হেমন্তি দুষাদ এবং লক্ষ্মীরাণী হাজরা। এভাবেই দলের অন্যদের নাম বলেন রশিক দুষাদ।
কৃত্রিম এ জলাশয় নির্মাণ সম্পর্কে উপজেলা মৎস্য অফিসের মাঠ সহায়ক আবদুল রাজ্জাক বলেন, প্রজনন ও প্রদর্শনীর জন্য তৈরি করা এই পুকুরটির দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট, প্রস্থ ১২ ফুট এবং গভীরতা সাড়ে তিন ফুট। আমাদের এ প্রদর্শনী খামারটি দেখতে প্রতিদিন লোকজন দূরদূরান্ত থেকে আসছেন।
সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান খান বলেন, ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে আমরা এ প্রকল্প হাতে নিয়েছি। গত ফেব্রুয়ারি মাসের ৬ তারিখ ভাড়াউড়ার এ প্রদর্শনী খামার উদ্বোধন করা হয়েছে। খামারে সর্বমোট মোট ৪০ কেজির ১২শ’ থেকে ১৫শ’ কুচিয়া আছে।
কুচিয়ার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি বলেন, কুচিয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ওরা গর্ত করে এদিক-ওদিক চলাচল করে। প্রদর্শনী খামারের কুচিয়াগুলো যাতে গর্ত করে না যেতে পারে তার জন্য একদম নিচে পলেথিন তার উপর মোটা ত্রিপল দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। তার উপর খড়, গোবর, কলাপাতা, ইউরিয়া ও টিএসপি সার, চুন এবং মাটি দেওয়া হয়েছে।
মাছের খাবার সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রথম দিকে দৈনিক তিন/চারশ’ টাকার মাছ দেওয়া হয়। মাছগুলো হলো- গুতুম মাছ, শুটকি মাছ, শামুক, কেঁচো এবং ছোট জীবন্ত মাছ। এখন দৈনিক দেড়-দু’শো টাকা খরচ হচ্ছে।
সফলতার প্রসঙ্গ টেনে মো. মাহবুবুর রহমান খান বলেন, নিয়মিত পরিচর্যা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থগুলো ঠিক ঠিকভাবে পালন করলে একবছর পর এই প্রকল্প সফলতার মুখ দেখবে। প্রায় দেড় লাখ টাকা আয় করা সম্ভব হবে বছরে। আমরা সম্পূর্ণ বিনামূল্য তাদের একবছর পর্যন্ত আর্থিকসহ বিভিন্ন সহযোগিতা দিয়ে যাবো। একবছর পর খামারটি ওই বারো সদস্যবিশিষ্ট দলের হয়ে যাবে। প্রতি কেজি কুচিয়ার বাজারদর তিন থেকে চারশ’ টাকা।
মৌলভীবাজার জেলার মৎস্য কর্মকর্তা আ ক ম শফিক-উজ-জামান বলেন, আমাদের জেলার মধ্যে শুধু শ্রীমঙ্গলেই পরীক্ষামূলকভাবে এ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক জলজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি এবং অ্যাকুয়াকালচার পদ্ধতি- এই দুই পদ্ধতিতে কুচিয়ার চাষ করা যায়। আমরা অ্যাকুয়াকালচার পদ্ধতি হাতে নিয়েছি। এটি সফল আমরা আরও উদ্যোগ নেবো।
এদের সম্পর্কে তিনি বলেন, বড়শি দিয়ে ধরা কিছু কুচিয়া সংগ্রহ করা হয়েছিল; ওগুলো চিকিৎসা না করে সরাসরি ছেড়ে দেওয়াতে মুখে ঘা হয়ে মরে গেছে। ওগুলোর প্রতি বিশেষ নজর আমাদের রয়েছে।
কুচিয়া অত্যন্ত ক্ষতসহিষ্ণু প্রাণী। সাধারণ আঘাতে মরে যাওয়ার কথা নয়। অতিরিক্ত আঘাতে এমনটা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা।
ঢাকা মৎস্য অধিদপ্তরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শেখ মুসতাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, এই প্রাণীটা আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের খুবই প্রিয় একটি খাবার। এটি বাংলাদেশের একটি ভালো ইমপোর্ট আইটেমও। কিন্তু এটি অপ্রচলিত। আমরা কেউ এর চাষ করি না।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ‘বাংলাদেশের নির্বাচিত এলাকায় কুচিয়া ও কাঁকড়া চাষ এবং গবেষণা প্রকাল্প’ নামে একটি পরিবেশবান্ধব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আমরা কুচিয়াকে প্রকৃতি থেকে ধরে এনে অ্যাকুয়াকালচার পদ্ধতিতে কৃত্রিমভাবে চাষ করছি এবং এর প্রজনন ঘটাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, কুচিয়ার আরেকটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো ওরা নিজেদের বাচ্চা নিজেরা খায় এবং ওরা নিশাচর প্রাণী। এটি যাতে না করতে পারে তার জন্যও আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। বাচ্চা জন্মানোর পরপরই তাদের পাশের একটি কৃত্রিম পরীক্ষণ পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হবে। আমাদের বিশ্বাস এটি সফলতার মুখ দেখবে। এটি সফল হওয়ার পর চিংড়ির মতো সাড়া পড়ে যাবে।
কুচিয়ার উপকারিতা সম্পর্কে তিনি বলেন, অন্য মাছের থেকে কুচিয়া খুবই উপকারী। প্রথম কথা হলো এই মাছ আমাদের শরীরের বিভিন্ন ব্যথা দূর করে; দ্বিতীয়ত আমাদের শরীরের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে হার্টকে ভালো রাখে; তৃতীয়ত আমাদের পরিপাকতন্ত্রের হজমশক্তির ক্ষমতা বাড়ায়।
তিনি আরও বলেন, আমি নিজেও কুচিয়া খুবই পছন্দ করি। তবে আমাদের সাধারণ বাঙালিরা তেমন পছন্দ করেন না। এটি না খাওয়ার কোনো যুক্তি খুঁজে পাই না আমি।
দেশে ও আন্তর্জাতিক বাজারে এর যথেষ্ঠ চাহিদা থাকায় চাষের ব্যাপকতা বাড়িয়ে রপ্তানি করা সম্ভব বলেও মনে করেন এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ১০০১ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০১৬
বিবিবি/এএ