ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

বনখেকো বন বিভাগ!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১৫ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৪
বনখেকো বন বিভাগ! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চরমোন্তাজ, রাঙ্গাবালী, পটুয়াখালী ঘুরে এসে: সংরক্ষিত বন রক্ষার দায়িত্বে বন বিভাগ, অথচ এই বন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজনের তত্ত্বাবধানেই উজাড় হয়ে যাচ্ছে বন। সংরক্ষিত বন এলাকার দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বন বিভাগের মাঠের কর্তারা।

বনের কাঠ বেচাকেনা, বছর-চুক্তিতে খাল লিজ দেয়া, মাসোহারার বিনিময়ে লাইসেন্স বিহীন করাতকল চালুর রাখায় সহায়তা করাসহ বহুমূখী উপার্জনের পথ তাদের। বন বিভাগের এই সাম্রাজ্যে জিম্মি সাধারণ মানুষ।

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চরমোন্তাজে পা পড়তে না পড়তেই কানে আসে বন বিভাগের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। নদীতে মাছ ধরা, বনে কাঁকড়া ধরা, লাকড়ি কুড়ানো, মহিষ চড়ানো থেকে শুরু করে বনকেন্দ্রিক সব কর্মকাণ্ডেই বন বিভাগের জন্য ‘বাড়তি রোজগারের’ পথ খোলা। বনকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী পাস পারমিটের ব্যবস্থা আছে ঠিকই, তবে তা একেবারেই কাগজে-কলমে।

সংরক্ষিত বনের গা ঘেঁসে জেগে থাকা এই দ্বীপে রয়েছে বন বিভাগের একটি রেঞ্জ। আর এর অধীনে রয়েছে চারটি বিট ও ক্যাম্প অফিস। এই চার কর্মকর্তার মধ্যে সদরের চরমোন্তাজ বিটের কর্মকর্তা আ. জব্বারের নামটা এলাকার সবাই জানেন। মাত্র ছয় মাসে অনেক পরিচিতি অর্জন করেছেন এলাকায়। বনের কাঠ বেচাকেনা, করাতকল থেকে মাসোহারা আদায়, বনের খাল লিজের মত ঘটনা থেকেই তার নামটা এলাকায় ব্যাপক পরিচিত বলে দাবি এলাকাবাসীর।

তবে বিট কর্মকর্তা আব্দুল জব্বারের দাবি, সুখে-দুঃখে এলাকার মানুষের পাশে থাকেন বলে সবাই তার নাম জানেন। বাংলানিউজের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এলাকার কিছু মানুষের অন্যায় আবদার রক্ষা করতে পারেন না বলে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করা হয়।
    
এলাকাবাসীদের অনেকের দাবি, চরমোন্তাজ স্লুইজ বাজারে ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের তাণ্ডবে বাবলা ও পায়রাসহ বিভিন্ন প্রজাতির অন্তত ৪০০ গাছ ভেঙে পড়েছিল। বন বিভাগের নিয়ম অনুসরণ না করেই এই গাছ বিক্রি করা হয়েছে। বিট কর্মকর্তা আব্দুল জব্বার এই গাছ বিক্রির শেষ ভাগটা পেয়েছিলেন। বাকিরা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. কামালুজ্জামানের নেতৃত্বে আগেই ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যায়।

এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধের বনের কাঠ কেটে বিক্রি করে উজাড় করে ফেলা হয়েছে। কিছুদিন আগে নয়ারচর এলাকায় ১৫ পিস গাছ বিক্রির সময় এলাকাবাসীর হাতে ধরা পড়েন বিট কর্মকর্তা আব্দুল জব্বার। বউবাজার এলাকায় ২০ পিস গাছ কেটে টাকার বিনিময়ে মনির খান নামক ব্যক্তিকে ঘর তুলতে গিয়েছেন। বউ বাজার এলাকায় আরও অনেক ঘর তোলা হয়েছে বনের গাছ দিয়ে। বিনিময়ে বিট কর্মকর্তা টাকা নিয়েছেন।

অভিযোগ রয়েছে, বিট কর্মকর্তা আব্দুল জব্বার নিজেই টাকা তুলেন সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে। টাকা গ্রহণের জন্য তার একটি বিকাশ একাউন্টও রয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকে রয়েছে আরও একটি একাউন্ট। বিভিন্নভাবে উপার্জিত টাকা এই একাউন্টে জমা হয়।

এ দুই একাউন্টের লেনদেন থেকেও তার মাসিক আয় ধারণা করা সম্ভব বলে স্থানীয়রা জানালেন।    
Upokul_1_  
লাইসেন্স বিহীন করাতকল থেকে মাসিক ভিত্তিতে বাড়তি আয় করেন রেঞ্জ ও বিট কর্মকর্তারা। মধ্য চরমোন্তাজের আবদুল কাদের আকন, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আল-আমীন মাল, পশ্চিম চরমোন্তাজের জিয়া ফরাজী ও চর মন্ডলের বশার খন্দকারের করাতকল থেকে মাসোহারা পান চরমোন্তাজ বিটের কর্মকর্তা আব্দুল জব্বার।

অন্যদিকে দাঁড়ভাঙ্গার আবু মিয়া ও মার্গারেটের কাশেম মোল্লার করাতকল থেকে মাসোহারা পান বলইবুনিয়া বিটের কর্মকর্তা মো. ঈসা।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, করাতকলের কারণে আশাপাশের সংরক্ষিত বনাঞ্চল ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। চরমোন্তাজের দাঁড়ভাঙ্গা সুইজগেটের বিপরীতে নদীর ওপারে বনের ভেতরে একটি ছোট্ট খাল চলে গেছে। এই খালের ভেতরে এক কিলোমিটার গেলে চোখে পড়ে বন ফাঁকা হয়ে যাওয়ার দৃশ্য। রাতের আঁধারে এই এলাকা থেকে কাঠ কেটে করাতকলে নিয়ে চেরাই করা হয়।       

চরমোন্তাজ সদর বিটের আওতাধীন চর আন্ডার নতুন বেড়িবাঁধের ওপরে বাগান করেছিল বন বিভাগ। লাগানো হয়েছিল ৪০ হাজার গাছের চারা। গোটা বাঁধ ঘুরে ৪০টি গাছের চারাও পাওয়া যায়নি। বাগানের পাশে নতুন সাইনবোর্ডটি দাঁড়িয়ে থাকলেও গাছগুলো মরে গেছে। সাইনবোর্ডে ৭-৮ প্রজাতির গাছের কথা উল্লেখ থাকলেও বাঁধে ছড়ানো-ছিটানো কিছু বাবলা গাছের চারা চোখে পড়েছে।

এ বিষয়ে সদরের বিট কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, লবণাক্ততার কারণে কিছু চারা মরে গেছে। বাজেট না থাকায় পূনরায় চারা লাগানোর সুযোগ নেই। এছাড়া তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অন্যান্য অভিযোগও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন এই বিট কর্মকর্তা।

চরমোন্তাজের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জেলেদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া যায়, বনের খালগুলো প্রভাবশালীদের কাছ থেকে লিজ দেয় বন বিভাগ। খালের আকার ভেদে দেড়-দুই লাখ থেকে চার-পাঁচ লাখ টাকায় বছর-চুক্তিতে এই লিজ দেয়া হয়। চৈত্র-বৈশাখ মাসের মধ্যেই লিজ দেয়া সম্পন্ন হয়। যদিও বছর-চুক্তিতে লিজ দেয়ার কোনো বিধান নেই।

প্রভাবশালীদের কাছে লিজ দেয়ার ফলে হতদরিদ্র জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরেজমিন তথ্য সংগ্রহে গেলে বাংলানিউজের কাছে তারা অভিযোগ করেন, বন বিভাগের কাছে মাছধরার পাসের জন্য গেলে দেয়া হয় না। মাছ ধরতে হলে এই জেলেদেরকে ধর্ণা দিতে হয় খালের লিজ গ্রহনকারী প্রভাবশালীদের কাছে। তাদেরকে টাকা দিয়ে মাছ ধরার অনুমতি পেলেও আহরিত মাছ আবার ওই প্রভাবশালীদের কাছেই বিক্রি করতে হয়।

অভিযোগ রয়েছে, লিজ গ্রহণকারী প্রভাবশালীরা নিজেদের ইচ্ছামত মাছ ধরে। বনের গাছ কেটে খুটা জালে ব্যবহার করে। মাছ ধরার জন্য খালে বিষ প্রয়োগ করে। এরফলে অনেক প্রজাতির মাছ মরে যায়। দেশীয় ও অতিথি পাখিও মারা পড়ে। মোটা অংকের বিনিময়ে নেয়া লিজ গ্রহণকারীদের বন বিভাগও কিছু বলতে পারে না।

বাংলানিউজের আলাপে সবকিছুই অস্বীকার করলেন বন বিভাগ চরমোন্তাজ রেঞ্জের দায়িত্বে থাকা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. কামালুজ্জামান। এমনভাবে উপস্থাপন করলেন, মনে হলো সবকিছুই যেন ঠিকঠাক চলছে। কিন্তু চরমোন্তাজের একজন মানুষও তার এই জবাবে একমত হতে পারেননি।

বাংলাদেশ সময়: ০০১৫ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।