রাঙ্গাবালী, পটুয়াখালী ঘুরে এসে: হলদে বর্ণের ছোট্ট একতলা ঝকঝকে নতুন ভবন দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে লোকজন শূন্য।
দেশের সর্বদক্ষিণে সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে থাকা পটুয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা রাঙ্গাবালীতে কমিউনিটি ক্লিনিকের চিত্র এমনটাই। বেশ কয়েকটি কমিউনিটি ক্লিনিক ঘুরে পাওয়া যায় হতাশার চিত্র।
স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার নির্দিষ্ট সময় সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টার মধ্যে গিয়ে এইসব ক্লিনিকে কোনো লোকজন পাওয়া যায়নি। ক্লিনিকের কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই জানাতে পারেননি স্থানীয় বাসিন্দারা। ক্লিনিক থেকে সেবা পেয়েছেন, এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী এক একটি ক্লিনিক থেকে ছয় হাজার মানুষের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার কথা থাকলেও এসব এলাকার ক্লিনিকগুলো থেকে ছয়জন মানুষের ভাগ্যেও সে সেবা জোটে কীনা সন্দেহ।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা এলাকার মানুষ পান না বললেই চলে। অনেক রোগী ক্লিনিক তালাবদ্ধ দেখে ফিরে যান। তারা অনেক সময় স্বাস্থ্যকর্মীর দেখাও পান না। কালে-ভদ্রে স্বাস্থ্য বিভাগের কারও দেখা মিললেও চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় না।
সূত্র বলছে, কমিউনিটি ক্লিনিকে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) পদে কর্মরতদের কর্মদিবসে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করার কথা। স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার পরিকল্পনা সহকারীদের প্রত্যেক ক্লিনিকে সপ্তাহে ৩ দিন করে দায়িত্ব পালনের কথা। কিন্তু রোগীরা ক্লিনিকে এসে তাদের কাউকেই এই সময়ে পান না।
সরেজমিনে ঘুরে বাংলানিউজ দেখতে পায়, রাঙ্গাবালী উপজেলা সদর বাহেরচর থেকে খানিক দূরের গণ্ডাদুলা গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকটি বন্ধ। তখন দুপুর মাত্র সাড়ে ১২টা। ক্লিনিকের নতুন ভবনটির সামনের গেট তালাবদ্ধ। ভেতরে আছে কিছু পোস্টার। ক্লিনিক ভবনের সামনে থাকা নলকূপটি বিকল হয়ে আছে। স্থানীয় লোকজন বলতে পারেননি কখন এ ক্লিনিকটি খোলা হয়, কিংবা এখানে কী সেবা পাওয়া যায়।
ক্লিনিকের আশপাশের গ্রামের স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, এ ক্লিনিকটির ভবন নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০১৩ সালের অক্টোবরে। এর আগে এখানে স্যাটেলাইট ক্লিনিক বসতো। এলাকার মানুষ আশা করেছিলেন, ভবন নির্মাণের পর এখান থেকে যথাযথ সেবা পাওয়া যাবে। কিন্তু ক্লিনিকটির সিএইচসিপি’র দায়িত্বে থাকা নূরে আলম বিপ্লবকে এখানে পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
ওদিকে ক্লিনিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই ব্যক্তি একইসঙ্গে রাঙ্গাবালী হালিমা খাতুন মহিলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে রয়েছেন বলে জানা গেছে। একইসঙ্গে তার দুটো পদের দায়িত্ব পালন নিয়ে এলাকাবাসীর মনে নানা প্রশ্ন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নূরে আলম বিপ্লব বাংলানিউজকে বলেন, একইসঙ্গে দুই পদে দায়িত্বে থাকার অভিযোগ সত্য নয়। কোনো কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে তিনি নেই বলেও দাবি তার।
সেবাকালীন সময়ে ক্লিনিক বন্ধ থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, তৃণমূলের মানুষকে সেবা দিতে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ক্লিনিক খোলা থাকে। প্রতিদিন ১৪-১৫ জন রোগী আসেন। তারা প্রয়োজনীয় সেবা পান।
রাঙ্গাবালী ইউনিয়নের নেতা বাজারের কাছে রয়েছে আরেকটি কমিউনিটি ক্লিনিক। সেখানেও একই চিত্র চোখে পড়ে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে গিয়ে দেখা যায় তালাবদ্ধ ও জনশূন্য থাকার চিত্র। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, ক্লিনিকটি খোলার কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি নেই। ইচ্ছা হলে খোলে, ইচ্ছা হলে বন্ধ রাখে। অনেক রোগী চিকিৎসা নিতে এসে ফিরে যান।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রাঙ্গাবালী উপজেলা সদর থেকে খানিক দূরে কাজীর হাওলা কমিউনিটি ক্লিনিক ভবন নির্মাণের কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে প্রায় দেড় বছর ধরে। ক্লিনিকের পাশের বাসিন্দা চাঁন মিয়া শিকদার, হোসেন শিকদার, জালালউদ্দিন দফাদারসহ আরও অনেকে জানালেন, ক্লিনিক না থাকায় এখানকার মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে অনেক দূরে যেতে হয়।
মাঠে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় দ্বীপের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকের ওপর ভরসা করতে হয়। বিচ্ছিন্ন এলাকা চরমোন্তাজ, চালিতাবুনিয়া, মৌডুবী ও চরবেস্টিনের মানুষের ভরসা হাতুড়ে বা গ্রাম্য ডাক্তার। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে প্রয়োজনীয় ওষুধ, অপ্রতুল সরঞ্জামাদি, লোকবল সংকট এবং কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে কাঙ্খিত স্বাস্থ্যসেবা মিলছে না।
কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে বিভিন্ন রোগের ২৯ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। আছে প্রাথমিকভাবে ব্লাড প্রেসার মেশিন (বিপি), গর্ভবতী মায়েদের রক্তচাপ মাপার যন্ত্র, প্যাথলজির প্রাথমিক কাজকর্ম করার মতো যন্ত্রপাতি। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের দাবি, ওষুধের পরিমাণ ও প্রকারভেদ বাড়াতে হবে। ক্লিনিকে একজন মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্ট অথবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য সহকারীর সপ্তাহে কমপক্ষে দু’দিন ক্লিনিকে রোগী দেখার কাজে নিয়োজিত রাখা খুবই জরুরি।
রাঙ্গাবালী উপজেলায় অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা পলাচিপা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, বিচ্ছিন্ন জনপদে স্বাস্থ্যসেবা দিতে কিছু সমস্যা হচ্ছে। তবে এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখানকার মানুষের যথাযথ সেবা নিশ্চিত করতে রাঙ্গাবালী উপজেলা সদরে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণের দাবি তারও।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৪