ঢাকা, শনিবার, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, ২৭ জুলাই ২০২৪, ২০ মহররম ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

দুর্যোগের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড জনপদ

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১, ২০১৪
দুর্যোগের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড জনপদ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বড়বাইশদিয়া, রাঙ্গাবালী, পটুয়াখালী ঘুরে এসে: প্রায় সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাক্ষী পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালীর বড়বাইশদিয়া  জনপদ।

সিডর, অইলা, মহাসেনসহ নাম না জানা বহু ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস সমুদ্র মোহনায় জেগে থাকা এই জনপদে আঘাত হানে।



বছরে অন্তত দু-চারবার ঝড়ের তাণ্ডব মোকাবেলা করতে হয় দ্বীপের হাজারো মানুষকে। প্রকৃতির বৈরিতায় মানুষগুলো সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়। আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাও করেন তারা। তবে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারি-বেসরকারি সাহায্য মেলে সামান্যই।

এ গল্প পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন বড়বাইশদিয়ার। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে যেখানকার মানুষের নিয়তির ওপর ভর করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। ঝড়ের মৌসুমে দ্বীপের একদিকে ভয়াল সমুদ্রের ঢেউয়ের ধাক্কা লাগে, অন্যদিকে আগুনমুখা নদী হয়ে ওঠে অগ্নিমূর্তি। বছরের প্রায় ছয়মাস সৃষ্টিকর্তার নাম ডাকা ছাড়া দ্বীপের মানুষের আর কোনো উপায় থাকে না।

সরেজমিন বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র তক্তাবুনিয়া বাজারে এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপকালে বাংলানিউজ জানতে পারে, সেখানকার ঝুঁকিপূর্ণ জীবনের গল্প।

এলাকাবাসীর বর্ণনায় উঠে আসে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ অবহেলায় ডুবে থাকার ফলে সৃষ্ট নানা সমস্যার চিত্র। জমিতে ফসল আবাদ করে জীবন-যাপনের দিন শেষ হয়ে গেছে চাষির। দুর্যোগের তাণ্ডব, মাছ না পাওয়াসহ বার বার লোকসান গুণতে গুণতে বহু জেলে বেকার হয়ে পড়েছেন। স্বাস্থ্য-চিকিৎসার কোনো সুবিধাই সেখানে নেই।

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই এলাকায় দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে, এমন কথাই বিপন্ন জনপদের মানুষের কণ্ঠে। একজন বলছিলেন, এলাকায় কোনো ধরনের চিকিৎসার ব্যবস্থা না করতে পেরে প্রসূতি মাকে ট্রলারে তুলে দিয়ে আমরা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে আসি। সৃষ্টিকর্তাকে ডাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।

প্রবীণ চাষি আফতের আলী জানাচ্ছিলেন, ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের কথা। ঝড়ের মৌসুমের ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ঝড় এলে আমরা কোথায় যাবো কোনো উপায় খুঁজে পাইনা। অনেক দূরের সাইক্লোন শেল্টারে যাওয়ার কোনো পথ থাকে না। তাই, সবাই বাড়িতেই বসে থাকি। কখনো আবার স্কুলের ভবনে উঠি। বছরে অন্তত দুই-তিনবার ঝড়ের তাণ্ডবে ছোটাছুটি করতে হয়।

বড়বাইশদিয়ার তক্তাবুনিয়া, গাইয়াপাড়া, মধুখালী, চরগঙ্গা, মৌডুবি, জাহাজমারাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষের একই কথা। ঝড় এলে তাদের বিপদের শেষ থাকে না। কিন্তু, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারের যেসব কর্মসূচি আছে, তার আওতায় আসতে পারেন না এই এলাকার মানুষ। এমনকি দুর্যোগের পর ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দেওয়া বরাদ্দও এদের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছায় না। এমন অভিযোগ করলেন, এলাকার বিভিন্ন পেশার মানুষেরা।

মৌডুবি বাজারের বাসিন্দারা বলেন, এই ইউনিয়নটি এক সময় ছিল বেড়িবাঁধের বাইরে। তখন এলাকার মানুষের জীবন বাঁচাতে বাঁধ নির্মাণের দাবি ছিল প্রধান। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাঁধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সে বাঁধ ঝুঁকির মুখেই রয়ে গেছে।

তারা বলেন, একদিকে বাঁধের কয়েকটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। নেই সংস্কারের উদ্যোগ। অন্যদিকে, বাঁধের সঙ্গে নির্মাণ করা স্লুইসগেটগুলো প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। বর্ষায় অনেক স্থানের পানি সরানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে, বাড়িঘর ডুবে যায়। ঘরের মালামাল নিয়ে তখন মানুষ আশ্রয়ের জন্য ছোটেন বেড়িবাঁধে।         

ইউনিয়নের সর্বদক্ষিণে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় বাঁধের ওপর এবং বাঁধের আশপাশে বাসবাসকারী বাসিন্দারা জানান, ঝড়ের সময় এই এলাকার মানুষ চরম আতঙ্কে দিন কাটান। সিডর, আইলা, মহসেনসহ সব দুর্যোগের ঝাপটা বয়ে গেছে, তাদের বাড়িঘরের উপর দিয়ে। প্রত্যেক দুর্যোগে এইসব মানুষেরা চরম আর্থিক সংকটে পড়েন।

বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপ হলো, জাহাজমারা এলাকায় বাঁধের বাইরে থাকা জেলে ফরিদ উদ্দিনের সঙ্গে। জানালেন, দুর্যোগে নৌকা হারিয়ে গিয়েছিল। ধারদেনা করে নৌকা বানিয়েছি। দেনা হয়ে পড়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। সারাদিন মাছ ধরে যা পাই, তাতে সংসার চলে না। দুর্যোগে সব সময় ক্ষতির মুখে থাকা মানুষের সাহায্যে তো কেউই এগিয়ে আসে না।           

রাঙ্গাবালী থেকে বড়বাইশদিয়া প্রবেশ পথে মধুখালী নামে এক স্থানে দারছিড়া নদীতে একটি ক্লোজার পার হতে হয়। দ্বীপ বড়বাইশদিয়াকে রাঙ্গাবালী উপজেলা সদরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে এ ক্লোজার নির্মাণ করা হয়েছিল।

স্থানীয় লোকজন জানালেন, বর্ষায় এই ক্লোজারটি চরম ঝুঁকির মুখে থাকে। সরেজমিন দেখা যায়, ক্লোজারের দুপাশে বালুর বস্তা ফেলে জোড়াতালি দিয়ে বাঁধ টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে।

এলাকাবাসীর প্রশ্ন, এভাবে জোড়াতালি দিয়ে কি দ্বীপের মানুষকে দুর্যোগের ছোবল থেকে বাঁচানো যাবে? 

বাংলাদেশ সময়: ঘণ্টা, এপ্রিল ০১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।