চিরিংগা, চকরিয়া, কক্সবাজার থেকে: পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বয়ে চলেছে জীবনের গলিপথ। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সব হারানো মানুষেরা পাহাড়ের চূড়ায় বাসা বেঁধে আবারও দুর্যোগের মুখে।
এ হচ্ছে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের বিপন্ন পাহাড় জীবনের গল্প। কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার পূর্বপ্রান্ত ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ছোটবড় পাহাড়। দূর থেকেই পাহাড়ের শরীর বেয়ে উপরের দিকে উঠে যাওয়া পথগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। পাহাড়ের ভেতরে এঁকেবেঁকে চলেছে সড়ক, মিশেছে এক ইউনিয়ন থেকে আরেক ইউনিয়নে। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে শুরু করে চূড়া পর্যন্ত ছড়ানো-ছিটানো ছোট ছোট মাটির ঘর।
সরেজমিন ঘুরে বাংলানিউজ জানতে পেরেছে, এই পাহাড়ের বাসিন্দারা বিভিন্ন এলাকা থেকে সব হারানো মানুষ। কেউ নদী-ভাঙনে নি:স্ব হয়েছে, কেউ মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে হারিয়েছে সব। কোথাও মাথাগোঁজার এক টুকরো ঠাঁই না পেয়ে অবশেষে এই পাহাড়ে বাসা বেঁধেছে। এইসব ছোট্ট বসতিকে ঘর না বলে বাসা বলাই ভাল। কারণ মাটির তৈরি এ ঘরগুলো বারবার ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়, প্রবল বাতাসের তোড়ে উড়ে যায় চালা-বেড়া। একেবারেই ক্ষণস্থায়ী জীবন এদের।
বৈশাখের তীব্র খরতাপে লাল মাটিতে সরু পথ ধরে পাহাড়ে উঠতে গিয়ে পথের ধারেই দিনমজুর মোহাম্মদ আলীর বাসা। ঘর বানানোর কাজ করেন, অথচ নিজের ঘরখানা একটু শক্ত করে বানানোর সামর্থ্য তার নেই। দিনমজুরি করে যা পাওয়া যায়, তা দিয়ে কোনমতে সংসার চালিয়ে নিচ্ছেন। মাটি দিয়ে তৈরি তার ঘরের ভেতরে দুটো ছোট্ট জানালা দিয়ে দখিণা বাতাস ঢুকতে পারে না, অথচ বাইরে প্রচণ্ড বেগে আসা বাতাসের ঝাপটায় মনে হয় এই বুঝি কোন দুর্যোগ এলো।
চকরিয়ার কাকারা ইউনিয়নের এই পাহাড়ের নাম নরসিংগা। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে এই পাহাড়। ৭০ পরিবারের প্রায় ৫ শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুর বসবাস এই পাহাড়ে। এই পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়ালে চোখে পড়ে আশপাশের পাহাড়েও রয়েছে অসংখ্য বসতি। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বসতি আর হাঁটাচলার পথ। ছোট্ট খণ্ড খণ্ড জমিতে ধান, বরবটি, করলা, শিমসহ নানা জাতের সবজির আবাদ। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট ছোট খাল, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে ছড়া। বর্ষায় এসব ছড়া পানিতে প্লাবিত হয়। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পাহাড়বাসীর যোগাযোগ।
কীভাবে এই পাহাড়ে লোকবসতি শুরু হল? এমন প্রশ্ন ছিল পাহাড়ে প্রথমদিকে আসা বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেনের কাছে। জানালেন, কোথাও কোন থাকার ব্যবস্থা না থাকায় প্রায় আট বছর আগে এই পাহাড়ে এসে ঠাঁই নেয় কয়েকটি পরিবার। তিনি বলেন, প্রথমদিকে বন বিভাগের অনেক বাঁধা ছিল। এ নিয়ে মামলা মোকদ্দমাও চলেছে অনেকদিন। এখনও নানা ধরনের বাধা রয়েছে। সেসব বাধা উপেক্ষা করে মানুষগুলো রয়েছে এখানে।
সরকারের লোক সরকারের জায়গা। বাড়িঘর নাই। কই যাব। এ কথাগুলো বলছিলেন পাহাড়বাসী জাহানারা বেগম। স্বামী ফরিদ আহমদ বেঁচে নেই। দুই ছেলেকে নিয়ে অতিকষ্টে এই পাহাড়ে দিন কাটছে তার। ফাতেমা বেগম, নাছির উদ্দিন, মো. রফিক, মোহসেনা বেগম, হামিদা বেগমসহ আরও অনেক মানুষের সঙ্গে আলাপকালে প্রত্যেকেই জীবনের নানা সংকটের কথা জানান।
পাহাড়ের বাসিন্দারা জানান, পরিবারগুলোতে চরম আর্থিক দৈন্যতা থাকলেও এখানকার মানুষ ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠায়। কিন্তু স্কুল অনেক দূরে হওয়ায় যাতায়াতে খুবই সমস্যা দেখা দেয়। বর্ষাকালে স্কুলে যাতায়াতের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। তখন অনেকের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
পাহাড়ের বাসিন্দাদের সঙ্গে তারা কাকারা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার ভোটার আইডি কার্ড দেখান। নির্বাচন এলে তারা ভোটও দেন। কিন্তু সরকারি সুযোগ সুবিধা তাদের ভাগ্যে জোটে না। চিকিৎসায় তাদের ভোগান্তির শেষ থাকে না। কয়েকটি নলকূপ পাহাড়ের মানুষদের বিশুদ্ধ খাবার পানির চাহিদা মেটায় বটে; কিন্তু প্রায় সব পরিবারেই খোলা পায়খানা ব্যবহার করে। ফলে দেখা দেয় নানা ধরনের রোগবালাই।
রাত হলে বন্য হাতির আক্রমণের ভয় পাহাড়বাসীর। দিনের বেলায় হাতি দেখা না গেলেও রাতে হাতির দল এসে তছনছ করে ক্ষেত-খামার। এমনকি বাড়িঘরও নষ্ট করে। ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত পেলেও পাহাড়ের মানুষ আতংকে থাকে। কারণ উঁচু পাহাড়ে ঝড়ের ঝাপটা আরও তীব্র মাত্রায় আঘাত হানে। বর্ষায় কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। তখন জীবিকার সংকট বেড়ে যায় কয়েকগুন।
পাহাড়ের বাঁকে এভাবেই ভূমিহীন মানুষগুলোর দিনগুলো অতিবাহিত হয়। এক অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে এরা পাহাড়ের বাঁকে খুঁজে ফেরে জীবনের গলিপথ। অপেক্ষা করে আরেকটি নতুন ভোরের।
বাংলাদেশ সময়: ০২৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০১৪