ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

একটা শক্ত উঁচু বাঁধের দাবি!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫০ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৪
একটা শক্ত উঁচু বাঁধের দাবি! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বদরখালী, চকরিয়া, কক্সবাজার ঘুরে এসে: সমুদ্রের পানি বাঁধ উপচে বাড়ি-ঘরে ঢুকে। তাই বাঁধের ওপরে সারিবদ্ধ ব্লক ফেলেছেন সমুদ্রপাড়ের বাসিন্দারা।

আবার কোথাও বিধ্বস্ত বাঁধের ফাঁক-ফোকর দিয়ে আসা পানি ঠেকাতে ফেলা হয়েছে বালুর বস্তা। যেখানে কোনো বাঁধ নেই, সেখানকার মানুষ সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকেন। বর্ষার কয়েকটি মাস তাদের জীবন একেবারেই বদলে যায়।

বঙ্গোপসাগরে জেগে থাকা দ্বীপ কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার সমুদ্র তীর ধরে কিলোমিটারের পর কিলোমটার হেঁটে এই চিত্র পেয়েছে বাংলানিউজ। কুতুবদিয়ার দক্ষিণ প্রান্ত তাবালর চর, কিরণপাড়া, হায়দারপাড়া, বড়ঘোপ, ধুরুংসহ বাঁধের পাড়ের বিপন্ন বসতিতে বসবাস করছেন হাজারো মানুষ। শুকনো মৌসুমে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও বর্ষায় তাদের জীবন থাকে হাতের মুঠোয়।

ঘরে শুয়ে এখানকার মানুষ সমুদ্রের ঢেউ দেখেন। সূর্যাস্তের লোভনীয় সময়টা উপভোগ করতে পারেন ঘরে বসেই। ইচ্ছে হলে সমুদ্রের সৈকতে বালুকাবেলায় খানিক সময় কাটিয়েও আসতে পারেন। কিন্তু সে সময় এখানকার মানুষদের নেই। সমুদ্রের সঙ্গে যেন তারা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেই বেঁচে আছেন। বর্ষা মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভয় বাড়তে শুরু করেছে। সমুদ্র উত্তাল হতে শুরু করেছে, কিন্তু নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই।

কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের হায়দারপাড়ায় সমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় রহমত উল্লাহ জানাচ্ছিলেন দুর্যোগের দিনের আতঙ্কের কথা। এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য সমুদ্রপাড়ের এই বাসিন্দা জানালেন, বাঁধ থাকলেও এ বাঁধ উপচে পানি ঢোকে বাড়ি-ঘরে। বাঁধের ওপর দিয়ে পানি আসে বলে সারিবদ্ধভাবে কিছু ব্লক ফেলে রাখা হয়েছে। এতে ঢেউয়ের ঝাপটা কিছুটা কমে।

খানিক দূরে কিরণপাড়া। এখানে বাঁধের একটি অংশ বিধ্বস্ত হলে এক বছর আগে মেরামত করা হয়েছে। কিন্তু যতোটা উঁচু করে বাঁধ করার প্রয়োজন ছিল, ততোটা হয়নি। ফলে বিধ্বস্ত এ অংশের ওপর দিয়েই পানি উপচে বাড়িঘরে ঢুকে পড়ে। গত বর্ষায় স্থানীয় উদ্যোগে বালুর বস্তা ফেলে বাঁধ মেরামত করা হয়েছে। কিন্তু এবারের বর্ষায় কী হবে এলাকাবাসী জানেন না।

কিরণপাড়ার বাসিন্দা মো. জাহাঙ্গীর আলম জানালেন, বিধ্বস্ত এ বাঁধের পাশে রয়েছে অসংখ্য বাড়ি-ঘর। বেশ কিছু চিংড়ি ঘের ও ফসলি জমিও রয়েছে। কোনোভাবে বাঁধ ভেঙ্গে গেলে ব্যাপক ক্ষতি হবে। শুনেছি, বাঁধ মেরামত করা হবে, কিন্তু এখনও তো কাজ শুরুই হলো না। বর্ষা তো এসে গেল।

আলী আকবর ডেইল ইউনিয়ন পরিষদ ভবন শান্তিবাজার নামক স্থানে। খোলা মাঠের ভেতর দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা পেরোলে সমুদ্র লাগোয়া গ্রাম তাবালর চর। এ রাস্তাটি বর্ষায় থাকে পানির নিচে। গোটা তাবালর চরের মানুষেরা তখন নৌকায় কিংবা সাতরে আসা-যাওয়া করেন।

তাবালর চর এলাকায় সমুদ্রের তীরে প্রায় এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধবিহীন অবস্থায় রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। সমুদ্রের বাঁকের কারণে পানির প্রবল চাপ থাকায় বার বার বাঁধ দেওয়া হলেও তা ভেঙে যায়। বর্ষা মৌসুম সামনে রেখে এখানে আবার নতুন বাঁধ হচ্ছে। কিন্তু কাজের মান নিয়ে এলাকাবাসী প্রশ্ন তুললেন। তারা অভিযোগ করেন, যেভাবে বাঁধে বালু ফেলা হচ্ছে, তাতে বর্ষা পর্যন্ত এ বাঁধ টেকসই হয় কি-না, সন্দেহ।

তাবালর চরের কুতুব বাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, এ এলাকার সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ আছে বলে আমাদের চোখে পড়ে না। একই সমস্যা দেখে আসছি যুগ যুগ ধরে। বাঁধ তৈরির জন্য যে টাকা ব্যয় হচ্ছে, সেটার যথাযথ ব্যবহার হলেও অন্তত কিছুটা রক্ষা হতো।        

কুতুবদিয়ার সর্বদক্ষিণে কুদিয়ার টেক নামক স্থানটি মানচিত্র থেকে প্রায় মুছেই গেছে। তাবালর চর বাজার থেকে খানিক সামনে গিয়ে ওই এলাকাটির শেষ চিহ্ন হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ির কয়েকটি গাছপালা দেখা যায়। বাড়িটি আছে নামে, কোনো ঘর সেই সেখানে। দু’চারজন মানুষ তাবালর চরে ঠাঁই নিয়েছেন। আর অনেকেই চলে গেছে কক্সবাজারের কুতুবদিয়াপাড়ায়।

কিরণপাড়া কিংবা হায়দারপাড়ার মানুষেরা এখন যেভাবে ভাঙন রোধ, জলোচ্ছ্বাস রোধ আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি তুলছেন- কুদিয়ার টেক এলাকার মানুষও একই দাবি তুলে আসছিলেন যুগ যুগ ধরে। কিন্তু সে দাবি কারও কর্ণপাত হয়নি। শেষ রক্ষা হয়নি কুদিয়ার টেকের তিন সহস্রাধিক মানুষের। ওই এলাকার পাশেই তাবালর চর এলাকাটিও এখন বিপন্ন। হয়তো কুদিয়ার টেকের পথ ধরতে হবে তাবালর চরসহ কুতুবদিয়ার আরও অনেক এলাকার। তারপরও কুতুবদিয়ার বিপন্ন মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কি-না, জানেন না এলাকাবাসী।      

একটা উঁচু আর শক্ত বাঁধের দাবি এলাকার মানুষের। তাহলেই সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁধের তীরের মানুষদের বাঁচানো সম্ভব হবে।  

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিনে ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]


বাংলাদেশ সময়: ০৮১০ ঘণ্টা,  মে ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।