তাবালর চর, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার ঘুরে এসে: এক একটা ঝড়ের মৌসুম আসে, আর উপকূলের মানুষ নতুন করে টিকে থাকার প্রস্তুতি নেয়।
বড় দুর্যোগ না এলেও বর্ষায় বেড়ে ওঠা জোয়ারের পানি আর ঢেউয়ের ঝাপটা থেকে বাঁচতে সমুদ্র পাড়ের মানুষদের বার বার প্রস্তুতি নিতে হয়।
এবার দুর্যোগ আর বর্ষা মৌসুমের ঠিক আগ মুহূর্তে সন্দ্বীপ ও কুতুবদিয়াসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে উপকূলবাসীর সেই প্রস্তুতিই দেখা গেল। বিপন্ন এই মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তাদের ঝুঁকি আর আতঙ্কের কথা।
কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দক্ষিণে তাবালর চর। আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের আট নম্বর ওয়ার্ড। পাশেই সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ। নিচু বাঁধ ছুঁয়ে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। এ যেন সমুদ্রের সঙ্গে বসবাস। তিন/চার বছরের শিশুদের খেলাধুলা থেকে শুরু করে বাড়ির নানা কাজকর্ম চলে সমুদ্রের পাশেই।
স্থানীয়দের ভাষায় ‘সুদিনে’ (শুকনো মৌসুমে) সমুদ্র তাদের ‘বন্ধু’ হয়ে থাকে। কিন্তু বর্ষার ছয় মাস সমুদ্রের সে রূপ বদলে যায়। ঝড়ের ঝাপটা সরাসরি এসে এই তাবালর চরের মানুষদের বাড়িঘর লণ্ডভণ্ড করে দেয়। তখন সমুদ্র পাড়ের মানুষদের জীবনে নেমে আসে চরম দুর্দিন। সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে জীবন। কাজের অভাবে কেউ দু’এক বেলা না খেয়ে থাকলেও এদের খোঁজ কেউ নেয় না। কথা বলার সময় ভিড় করা মানুষেরা সেসব কথাই জানাচ্ছিল।
দিনমজুর আব্দুল জব্বারের ছোট্ট ঘরটা তাবালর চরে সমুদ্রের পাশে বাঁধের ঢালে অবস্থিত। প্রচণ্ড বাতাসে যাতে ঘরটা ভেঙে না পড়ে সেজন্য ঘরের চারদিকে রশি টানা দিয়ে রাখা হয়েছে। দেখে মনে হয়, রশিগুলো মাছধরা ট্রলারের ব্যবহৃত। চালার উপরে দেওয়া হয়েছে লবণ মাঠে ব্যবহৃত পুরানো কালো পলিথিন। এর উপর রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া ইটের টুকরো বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
জব্বার বলেন, যতটুকু সাধ্য আছে, তা দিয়েই ঘরটা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। নতুন মালপত্র কিনে ঘরটা আরও মজবুত করার সাধ্য তো আমাদের নেই। সারা বছরই এই ঘর গোছানোর কাজ চলে। তবে বর্ষার আগে ঘরের দিকে একটু বেশি নজর দিতে হয়।
এসময় পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন মফিজুল ইসলাম। নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই তার। কখনো লবণ মাঠে ঘাম ঝরানো, কখনো বা সমুদ্রে মাছ ধরা। বার বার জীবিকার এই পালাবদলের পরও দুর্যোগের মৌসুম সামনে রেখে ঘরটা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হয়। এবার ঘরে টিনের চালা দেওয়ার সামর্থ্য নেই বলে পুরোনো পলিথিনের উপর মাছ ধরার পরিত্যক্ত জাল বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। জোয়ারের পানি যাতে ঘরে ঢুকতে না পারে, সেজন্যে তার ঘরের চারপাশে মাটি উঁচু করে দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের বাংলাবাজার এলাকার বাঁধের পাড়ের মানুষেরা বর্ষাকালের পানি আর ঝড়-বাতাসের ভয়ে ঘর শক্ত করার কাজে ব্যস্ত। উপজেলার সর্বদক্ষিণের এই এলাকাটি শুধু বর্ষায় নয়, সারা মৌসুমেই দুর্যোগ ঝুঁকিতে থাকে। বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে নদীর। কখন ঘরটি ভেঙে চলে যায়, সেই আতঙ্ক আর ঝড়-ঝাপটার ভয় নিয়েই শক্ত করে ঘর বাঁধতে হচ্ছে তাদের।
সন্দ্বীপের সারিকাইত ইউনিয়নের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের বেড়িবাঁধের বাইরের এই এলাকায় থাকেন মোমেনা বিবি। স্বামী আজিজ উল্লাহ বেঁচে নেই। দুই ছেলেসহ তাদের ঘরটিতে সদস্য সংখ্যা আট। দুর্যোগের এ মৌসুমে ঘরটি বিভিন্নভাবে শক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। পলিথিনের উপর কিছু খরকুটো দিয়ে তার উপর পুরনো জাল ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মাটির নিচে গাছের গুঁড়ি পুঁতে রশি লাগিয়ে ঘরের সঙ্গে টানা দেওয়া হয়েছে।
বর্ষার আগে উপকূলের এইসব এলাকায় এমন নানা প্রস্তুতি চোখে পড়ে। নতুন ঘর বানানো, ঘর মেরামত করা, বাড়ির চারপাশ মাটি দিয়ে উঁচু করাসহ নানান দৃশ্য চোখে পড়ে। এ যেন নিজেদের মতো করে একটা মৌসুম বেঁচে থাকার চেষ্টা।
ঘরটাকে একটু শক্ত করার এই চেষ্টা আদৌ এদের ঝড় থেকে বাঁচাতে পারবে কিনা কারো জানা নেই।
সন্দ্বীপের রহমতপুর ইউনিয়নের পশ্চিম প্রান্তে মেঘনা নদীর গা ঘেঁসে জেগে থাকা গ্রামের বাসিন্দা সফিকুল ইসলাম বলেন, দুর্যোগের পর আমাদের কাছে সবাই আসে। কিন্তু দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য আমরা কীভাবে আরও ভালো প্রস্তুতি নিতে পারি, সে বিষয়ে কেউ সহায়তা করে না।
রহমতপুর ইউনিয়নের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার বাংলানিউজকে বলেন, দুর্যোগের ওপর আমাদের হাত নেই। দুর্যোগ হয়ে গেলে হয়তো কিছু সাহায্য করা যায়। কিস্তু ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য দুর্যোগের প্রস্তুতির ওপর আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০৪৫৫ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৪