সাউথখালী, শরণখোলা, বাগেরহাট থেকে: কেউ ট্রলার মেরামতের কাজে ব্যস্ত, কারও সময় যাচ্ছে পুরানো ছেঁড়া জাল বুননে, আবার কেউ ছোট্ট নৌকাটির ছাউনি লাগাচ্ছেন।
এটা বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি।
উপকূলীয় জেলা শরণখোলার সাউথখালী, গাবতলী, বগী, তেরাবেকা, মোরেলগঞ্জের খাউলিয়া, সন্যাসী, খুলনার বটিয়াঘাটার কাতিয়ানাংলাসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে এ তথ্য মেলে।
সাউথখালী ইউনিয়নের বলেশ্বর নদীর তীর ঘেঁষা তাফালবাড়ি, গাবতলী, উত্তর সাউথখালী, দক্ষিণ সাউথখালীর বাঁধের আশপাশে বাংলানিউজের চোখে পড়ে জেলেদের প্রস্তুতির নানান দৃশ্য। মাছধরার মৌসুম সামনে রেখে কিছু বাড়তি আয়-রোজগারের বহুমুখী আয়োজন তাদের।
মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতিতে থাকা জেলেরা জানালেন, কিছু জেলে মৌসুমের প্রথম দিকে সাগর-নদীতে মাছ ধরতে নামলেও অনেকে এখনও প্রস্তুতি শেষ করতে পারেনি। এবারও সমুদ্রে বড় বিপদ হিসাবে জলদস্যু আর দুর্যোগের ভয় করছেন।
এরইমধ্যে সুন্দরবনের আশপাশের এলাকায় বেশ কয়েকটি ট্রলার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় এসব জেলেরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এইসব জেলেদের মধ্যে আবার অনেকেই গত বছর কিংবা তার আগের বছর দস্যুর কবলে সব হারিয়েছেন।
শরণখোলার বড় মাছঘাটগুলোর একটি গাবতলী। জেলে সোবাহান হাওলাদারের বাড়ি এখানে। নিজেই ট্রলারের মালিক। মৌসুমের প্রায় মাসখানেক অতিবাহিত হতে চললেও মাছ ধরতে নামতে পারেননি। গত মৌসুমে মাছ ধরতে গিয়ে দস্যুদের আস্তানায় আটকাপড়া ট্রলারটি কিছুদিন আগে উদ্ধার করতে পেরেছেন। সেটি মেরামতের কাজ চলছে। মাছ ধরতে সমুদ্রে যেতে হলে ট্রলার মেরামতের জন্য এক লাখ টাকা, জাল ক্রয় একলাখ টাকা, জেলেদের অগ্রিম ৭০ হাজার টাকা আর কাঁচাবাজার আরও প্রায় ৬০ হাজার টাকার প্রয়োজন।
সোবাহান হাওলাদার বলেন, এই টাকা খরচ করে মাছ ধরতে গিয়ে দস্যুদের কবলে পড়লে মুক্তিপণ দিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন বাহিনী মৌসুম এলে ২০ হাজার টাকা করে কার্ড বিক্রি করে। বলা হয় এই কার্ড থাকলে দস্যুদের হাতে ট্রলার আটক হবে না। কিন্তু কার্ড নিয়েও লাভ হয় না। এক বাহিনীর কার্ড নিলে অন্য বাহিনী ধাওয়া করে।
আরেকজন ফিরোজ খান। মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য ট্রলার ঠিকঠাক করা হচ্ছে। এতদিন ট্রলার ঠিক করতে পারেন নি আর্থিক সংকটের কারণে। ট্রলার মেরামতে ৫০-৬০ হাজার টাকা লাগবে, আর মাছ ধরতে যেতে লাগবে আরও অন্তত ৮-১০ লাখ টাকা। একদিকে এই টাকা সংগ্রহের চিন্তা, অন্যদিকে দস্যু আর দুর্যোগের ভয়।
ফিরোজ খান বলেন, সাগরে মাছ ধরতে যেতে বড় ভয়টাই হচ্ছে জলদস্যু।
সমুদ্র মোহনার এইসব এলাকায় যত জেলের সঙ্গে দেখা হয়েছে, প্রায় সবাই একই আতঙ্কের কথা জানিয়েছেন। মাছ ধরতে গিয়ে এই দুই প্রধান বিপদের মুখে পড়েছেন বহু জেলে। একের পর এক বিপদ তাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। এ কারণে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া বন্ধ করে অনেকে ছোট নদীতে মাছ ধরছেন। তবে সব জেলের জন্যেই মাছের এই মৌসুমটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শরণখোলার রায়েন্দা বাজারের কাছে বেড়িবাঁধের বাইরে ছোট্ট ঘরে থাকেন জেলে রতন হাওলাদার। তাকে এখন আর পুরোমাত্রায় জেলে বলা যায় না। এক সময় সমুদ্রে বড় ট্রলারে মাছ ধরতেন। দুর্যোগ আর দস্যুর আক্রমণে সমুদ্রে যাওয়া বন্ধ করে ছোট নদীর কিনারে মাছ ধরেন; আর মাছ পাওয়া না গেলে অন্য কাজ খোঁজেন।
রতন হাওলাদার জানান, সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে তাকে চারবার বড় বিপদের মুখে পড়তে হয়েছে। একবার ট্রলার ভাসতে ভাসতে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে আটক থাকতে হয়েছিল দু’মাস। একবার দস্যুর কবলে পড়ে দস্যুদের আস্তানায় থাকতে হয়েছিল আটদিন। আরেকবার দুর্যোগে ভাসিয়ে নিয়েছিল সুন্দরবনের কোন এক এলাকায়। তখন ক্ষুধা নিবারণের জন্য কাঁচা মাছ পর্যন্ত খেতে হয়েছে। সর্বশেষ প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের রাতে তাদের ট্রলারটি ছিল সমুদ্রে। পরেরদিন রাতে বাড়ি ফিরে দেখতে পান কিছুই নেই সেখানে।
জেলেরা জানান, সমুদ্র আর নদীতে আগের মতো মাছ নেই। সব আয়োজন করে মাছ ধরতে নেমেও মাছ পাওয়াই যেন ভাগ্যের ব্যাপার। গত দুই মৌসুমে সমুদ্রে তেমন মাছ পাওয়া যায়নি। তবুও এবার আশায় বুক বাঁধছেন জেলেরা। দস্যু-দুর্যোগের ভয় উপেক্ষা করেও তাদের ট্রলার-নৌকা ভাসছে সাগর-নদীতে।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০৫৪৫ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১৪