চর জ্ঞান, হাজীর হাট, মনপুরা, ভোলা থেকে: ঈদের একদিন আগেও সেমাই কেনার টাকা যোগানো সম্ভব হয়নি। পূরণ হয়নি ছেলেমেয়ে আর নাতি-নাতনিদের নতুন কাপড়ের বায়না।
ভোলার দ্বীপ মনপুরার ছোট্ট জেলেগ্রাম চর জ্ঞান সরেজমিন ঘুরে এসব তথ্য পেয়েছে বাংলানিউজ। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘনার উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গেই যেন এখানকার মানুষের জীবন এলোমেলো হয়ে যায়। জোয়ারে ঘরবাড়ি ডুবে আবার ঝড়ে উড়ে যায় ঘরের চালা। নানামুখী প্রাকৃতিক দুর্যোগে লণ্ডভণ্ড হয় এদের জীবন। এ কারণে এই প্রান্তিক জনপদে ঈদের আনন্দ যেন বারবারই ম্লান হয়ে যায়।
এসব পরিবারে এবারের ঈদ প্রস্তুতি কেমন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে রোববার (২৭ জুলাই) চর জ্ঞান ঘুরে সেখানকার নারী-পুরুষ ও শিশুদের সঙ্গে কথা বলেছে বাংলানিউজ।
জেলেগ্রামের বাসিন্দা ময়ফুল বিবি, স্বামী মো. হানিফ। কখনো এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে, কখনো নদীতে মাছ ধরতে যায়। ছেলেমেয়ে আর নাতি-নাতনিসহ ঘরে সদস্য সাত জন। কারও জন্যে ঈদের কোনো নতুন কাপড় কেনা হয়নি। ঘরের দাওয়ায় বসে ময়ফুল বলছিলেন, তিনবেলা ভাতই খাইতে পারি না। ঈদের কাপড় কিনমু ক্যামনে?
জেলেগ্রামে ঢুকতেই রাস্তার ওপরে বহু জেলের সঙ্গে দেখা। কেউ নদী থেকে ফিরেছেন, কেউবা নদীতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নদীতে যাওয়ার আগে জাল মেরামত করে নিচ্ছেন অনেকে। এদের কাছে ঈদ যেন বিশেষ কোন বার্তা বয়ে আনছে না। মাঝি অজিউল্লার নৌকায় ১০জন জেলের মধ্যে দু’জনের বয়স মাত্র ১৪ বছর। ফারুক হোসেনের ছেলে মহিউদ্দিন ও আব্দুল মান্নানের ছেলে সুজন। কিশোর বয়সে কাজে ঢুকে ওদের ভেতর থেকেও যেন ঈদের আনন্দ হারিয়ে গেছে।
সুজন জানালো, ঈদের দিন নৌকায় থাকবে। ঈদে বিশেষ কোন প্রস্তুতি তার নেই। ঈদে আনন্দ-ফুর্তি করা, বন্ধুদের সঙ্গে বেড়ানোর চিন্তা কখনই তার মাথায় আসে না। অত্যাধিক খাটুনি আর দরিদ্রতার নিষ্পেষণে এই কিশোরের কাছে কৈশোরের রঙিন দিন যেন ধূসর হয়ে এসেছে।
জেলেগ্রামের রাস্তার ওপরে জাল মেরামতে নিয়োজিত মো. আবুল কালাম বলেন, এক নৌকায় দশজন মাছ ধরতে যাই। তিন মাসে কিছুই পাইনি। অত্যাধিক খাটুনির পরেও প্রত্যেকে চার হাজার টাকা করে দেনা। ঘরে আটআনা পয়সাও নেই যে ঈদের জন্য খরচ করবো। অন্যদিন থেকে ঈদের দিনের কোনো পার্থক্য নেই আমাদের কাছে।
পড়ন্ত বিকেল। শ্রাবণের সূর্যটা মেঘে ঢাকা পড়ে পশ্চিম দিগন্ত রেখায় মিলিয়ে যাচ্ছে। গোধুলির পূর্ব মুহূর্তে জেলেগ্রামের কোলাহল অনেকটাই কমে এসেছে। রাস্তার দু’ধারে জেলেদের ছোট ছোট ঘর। শিশু-কিশোরেরা খেলছিল ঘরের সামনে। ডাকতেই অনেকজন ছুটে এলো। জাকির হোসেনের মেয়ে জান্নাত, মহিউদ্দিন আহমেদের ছেলে সাগর, ইসলামের মেয়ে নাজমাসহ আরও অনেকে।
ঈদের নতুন জামাকাপড় কিংবা অন্য প্রসাধনী কিছুই কেনা হয়নি ওদের। ধারদেনা করে দু’একজন অভিভাবক হয়তো ছেলেমেয়েদের কিছু নতুন কাপড় দিয়েছে, কিন্তু তা খুবই সামান্য। দারিদ্র্যে বড় হওয়া এই শিশু-কিশোরদের কাছে জীবনের বিশেষ সময়গুলো বিশেষ কোনো বার্তা নিয়ে আসে না। বড়দের মতো ওরাও যেন এই দিনের সঙ্গে অন্য দিনের কোনো পার্থক্য খুঁজে পায় না।
আলাপ হচ্ছিল জেলেগ্রামের নারীদের সঙ্গে। ঈদ সামনে রেখে এদের মুখটাই সবচেয়ে বেশি মলিন বলে মনে হলো। ছেলেমেয়েরা নতুন কাপড় না পাওয়ায় কিংবা ঘরে বিশেষ কোনো খাবার আয়োজন না থাকায় এরাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছেন। আবদুল মোতালিবের স্ত্রী মিনারা বেগম বলেন, কী আর করবো? চেয়ে-চিন্তে কারও কাছে কিছু পেলে কিছু রান্না করবো। না পেলে রান্না হবে না।
জেলেগ্রামের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিপন্ন মানুষের তালিকা আরও দীর্ঘ হতে থাকে। এতটুকু সহায়তার জন্য এরা নিজের এবং স্বজনদের নামটি লেখাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। তারা জানান, এই গ্রামের ভূমিহীন মানুষদের সহায়তায় কেউ এগিয়ে আসে না। ঈদের আগে ভিজিএফ-এর সামান্য চাল দেওয়া হলেও সবার ভাগ্যে তা জোটে না।
এটা শুধু মনপুরার একটা জেলেগ্রামের গল্প। কিন্তু একই অবস্থা এখানকার বহু জেলেগ্রামের। ভরা মৌসুমেও ইলিশ মিলছে না বলে জেলেদের হাত খালি। শুধু হাতখালি নয়, প্রায় সব জেলেরাই ধারদেনা করে সংসার চালাচ্ছেন। অনেক আশা নিয়ে জাল ফেলেন নদীতে, কিন্তু ইলিশ মেলে না। আর তাইতো এবারে তাদের ঈদ নিষ্প্রাণ।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০০৪৪ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৪