উপকূলের সিডর বিপন্ন জনপদ ঘুরে: সাত বছর ধরে গুমড়ে কেঁদে ফেরা মানুষের দল। হারানো স্বজনের জন্য কান্না থামেনি তাদের।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া, বাগেরহাটের শরণখোলার সাউথখালী, তাফালবাড়ি, রায়েন্দা, ভোলার চন্দ্রপ্রসাদ, যেখানেই জড়ো হওয়া মানুষদের সঙ্গে আলাপ হলো, সবাই সিডরের তাণ্ডবের উদাহরণটাই সামনে নিয়ে আসেন।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর রাতের দৃশ্য তাদের স্মৃতিতে এখনও জ্বলজ্বল করছে। কথা বলতে গিয়ে স্বজন হারানো মানুষের সেই হৃদয়বিদার ঘটনার দৃষ্টান্ত টানেন। তারা আর সেই বিভিষিকাময় দৃশ্যের মুখোমুখি হতে চান না। আর সে কারণেই নিরাপত্তার দাবিটাই তাদের কাছে প্রধান।
সিডর বিধ্বস্ত জনপদে সরেজমিনে গেলে দেখা মেলে বহু স্বজন হারানো মানুষের। এক গ্রামে পাওয়া মৃতদেহ এক স্থানে দাফন করা হয়েছে। দাফনের জায়গাটুকু পর্যন্ত ছিলো না। বেছে নেওয়া হয় রাস্তার ধারের উঁচু স্থান কিংবা রাস্তার ঢাল। জঙ্গলে পরিপূর্ণ এই গণ কবরের পাশে স্বজনেরা আসেন, দোয়া-দরূদ পড়েন, ভেজা চোখ নিয়ে ফিরে যান বাড়িতে। কিন্তু যারা স্বজনের লাশ পাননি, তাদের কষ্টটা একটু বেশিই। সিডরে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের জন্য দেওয়া সরকারি সাহায্যটা পর্যন্ত তাদের ভাগ্যে জোটেনি। কারণ লাশ দেখাতে না পারলে মিলবে না সহায়তা।
শরণখোলার সাউথখালীর গাবতলায় বেড়িবাঁধ থেকে খানিক ভেতরে সাইক্লোন শেলটারের পাশে সিডরে শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। নামেমাত্র দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি ইটের গাঁথুনি। অযত্ন-অবহেলায় স্মৃতিস্তম্ভ থেকে শহীদদের নামও মুছে গেছে।
প্রতিবছর স্থানীয়ভাবে এখানে সিডর দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও স্মৃতিস্তম্ভ সংরক্ষণে কারও উদ্যোগ নেই।
সিডরের মতো প্রলয়ংকারী এক ঘূর্ণিঝড়ে সব কেড়ে নেওয়ার পর বেঁচে যাওয়া বিপন্ন জনপদের মানুষেরা এখনও অনেক কষ্টে আছেন।
বলেশ্বর নদী আর সুন্দরবনের গা ঘেঁষে জেগে থাকা সাউথখালীর মানুষের ভয় কাটেনি এখনও। বারবার দুর্যোগের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হওয়া জীবন ভয়কে জয় করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন আজীবন।
সমুদ্র মোহনায় এই জনপদ ২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। আইলা, মাহাসেনের মতো ঝড়ের তাণ্ডব এই এলাকার মানুষ মোকাবেলা করেছে। তারপরও এই এলাকার মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
শরণখোলার উপজেলা সদর রায়েন্দা বাজার থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে বলেশ্বর তীরের গ্রাম সাউথখালী সরেজমিন ঘুরে সেখানকার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া গেছে দুর্যোগ ঝুঁকির নানান তথ্য। বর্ষায় এই ঝড়ের মৌসুমে নদী তীরের মানুষগুলো প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। সিডরে ক্ষতির পর যে সহায়তা পাওয়া গিয়েছিল, তা জীবনে গতি ফেরাতে পারেনি। নিঃস্ব মানুষদের অনেকেই কোনোমতে বসবাস করছেন বাঁধের ধারে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, যেখানে সিডর বড় ধাক্কাটা দিয়েছিল, কিংবা অন্যান্য দুর্যোগে যে জায়গাটি দিয়ে পানি উপচে লোকালয়ে ঢুকে পড়তো, সে জায়গাটি এখনও ঝুঁকিপূর্ণ। জোয়ারের পানি বাঁধ ছুঁই ছুঁই করছে।
স্থানীয়রা জানালেন, এই বাঁধ কোথাও ছয় ফুট, কোথাও আট ফুট আবার কোথাও দশ ফুট। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অন্তত কুড়ি ফুট উঁচু বাঁধের দাবি এলাকাবাসীর। প্রতিটি ঝড়ের পর একই দাবি উঠলেও সে দাবি কাগজেই থেকে যায়।
সূত্র বলছে, শরণখোলার পার্শ্ববর্তী মোরেলগঞ্জ উপজেলার খাওয়ালিয়া ইউনিয়নের সন্যাসী থেকে শুরু করে শরণখোলার বগী হয়ে শরণখোলা ঘুরে পুনরায় মোরেলগঞ্জ উপজেলা সদর পর্যন্ত বাঁধের অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ। এ বাঁধ কোনো বড় ধরনের দুর্যোগ ঠেকাতে পারবে না বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে। সাউথখালী ইউনিয়নের সোনাতলা এলাকায় বাঁধের উচ্চতা আট ফুট আর সাউথখালী এলাকায় এই উচ্চতা ছয় ফুটের বেশি নয় বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
রায়েন্দা ইউনিয়নের তাফালবাড়ি বাজারের ছোট্ট চায়ের দোকানে কথা হচ্ছিল ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শাহজাহান বাদল জোমাদ্দার, স্থানীয় বাসিন্দা জামাল হোসেন জোমাদ্দার, মিন্টু মিয়াসহ আরও অনেকের সঙ্গে। সিডরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তারা জানান, ওই দুর্যোগে অন্তত ১৫ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস এসেছিল। কিন্তু বাঁধ আছে মাত্র ১০ ফুট উঁচু। সিডরের পর বাঁধের বিভিন্ন এলাকায় কাজ হলেও তাতে উচ্চতা সর্বোচ্চ তিন ফুট বাড়তে পারে।
রায়েন্দা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শাহজাহান বাদল জোমাদ্দার বাংলানিউজকে বলেন, দুর্যোগের পরে অনেক প্রকল্প নেওয়া হলেও ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না। উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের আগে এলাকার মানুষের মতামত নেওয়া হয় না। আবার কখনো এলাকার মানুষেরা মতামত দিলেও তা গ্রহণ করা হয় না।
সাউথখালী ইউনিয়ন তথ্য কেন্দ্রের উদ্যোক্তা মো. জাকারিয়া বলেন, এলাকার মানুষ এখনও সারাক্ষণ ভয়ে থাকে। আকাশে মেঘ দেখলে মানুষেরা ছোটে আশ্রয়ের সন্ধানে। বর্ষায় নদী উত্তাল হয়, জোয়ারের পানি বাড়ে। বাঁধের তীরে ও বাঁধের বাইরে থাকা মানুষেরা তখন সংকটে দিন কাটায়।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার দাবি জানান তিনি।
স্থানীয়রা জানান, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বেশ কয়েকদিন ধরে এই এলাকায় ভারি বর্ষণে খালবিল আর ফসলি মাঠ পানিতে ডুবে আছে। নিচু এলাকার বাড়িঘরেও ঢুকেছে পানি। তাফালবাড়ি লঞ্চঘাটে বাঁধের পাশে মানুষদের বাড়িঘর ঘুরে চোখে পড়লো তাদের চরম দুর্দশার চিত্র। এই অবস্থায় তিনবেলা ভাত জোটানোও যেন তাদের পক্ষে কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শরণখোলার প্রাণকেন্দ্র দক্ষিণের ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্যকেন্দ্র রায়েন্দা বাজারটি রয়েছে বাঁধের বাইরে। এখানে নিরাপত্তাহীন আরও বেশকিছু বাড়িঘর ও সরকারি স্থাপনা। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয় গোটা বাজার। নিরাপত্তার জন্য মাত্র আড়াই কিলোমিটার বাঁধের দাবি এলাকাবাসীর।
এলাকা ঘুরে দেখা গেছে সাউথখালী ও তাফালবাড়িয়ার নদী তীরবর্তী এলাকায় বনের দেয়ালও নেই। সিডরে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া এই এলাকার বড় হওয়া গাছগুলো ভেঙে চুরমার হয়েছিল। ছয়-সাড়ে ছয় বছর বয়সী গাছের চারাগুলো কেবল মাথা তুলেছে। এই গাছপালা বড় হতে সময় লাগবে আরও কয়েক বছর। বছরে বছরের দুর্যোগের ঝাপটা কাটিয়ে কবে নাগাদ এই গাছগুলো আবার নিরাপত্তা দেবে, তা কারও জানা নেই।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়:০১৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০১৪