ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

পায়রা সমুদ্র বন্দর, স্বপ্নের হাতছানি!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০১৪
পায়রা সমুদ্র বন্দর, স্বপ্নের হাতছানি! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

টিয়াখালী, কলাপাড়া, পটুয়াখালী ঘুরে এসে: প্রত্যন্ত পল্লী সাজছে অন্যরূপে। রাস্তাঘাট হচ্ছে পাকা।

বসেছে বৈদ্যুতিক খুঁটি। অন্ধকারে ঢাকা গ্রামে এসেছে সৌরবিদ্যুতের আলো। নদীর তীর থেকে উঁচু সড়ক পর্যন্ত বিছানো হয়েছে ইট। একের পর এক চলছে কাজ। আর এসব কাজ ঘিরে মানুষের মধ্যে ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য। বহু কর্মহীন মানুষ কাজ পেয়েছেন। বেচাকেনার আশা নিয়ে বসেছে বেশকিছু দোকানও। অনেকে নতুন কোনো ব্যবসা নিয়ে বসার জন্য জায়গা খুঁজছেন।

এটা পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালীর কথা। এক সময়ের রূপকথাটা যেন এলাকার মানুষের চোখের সামনে। এখানেই রামনাবাদ নদীর তীরে গড়ে উঠছে পায়রা সমুদ্র বন্দর। শুরুর সময়টাতে দিনে দিনে বদলে যাচ্ছে এখানকার বৈচিত্র্য। উপজেলা সদর থেকে আঁকাবাঁকা পিচের সড়ক চলে এসেছে টিয়াখালী ইউনিয়নের এই নদীতীরে। নতুন বন্দর ঘিরে এখানকার মানুষের অনেক স্বপ্ন। আলাপে সেসবই বলছিলেন তারা।
paira_1
সূত্র বলছে, ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর পায়রা সমুদ্র বন্দরের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টিয়াখালী ইউনিয়নে ১৬ একর জমি অধিগ্রহণ করে পায়রা বন্দর প্রকল্প এলাকার কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর পায়রা সমুদ্র বন্দর কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৩ পাস হয় জাতীয় সংসদে। এরই আলোকে রামনাবাদ পাড়ের মধ্যবর্তী টিয়াখালী ইউনিয়নের ইটবাড়িয়াতে দেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। পায়রা সমুদ্র বন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের একটি তদারকি সেলও গঠন করা হয়েছে।

শ্রমিক মোবারক হোসেন কাজ করছেন পায়রা সমুদ্র বন্দরে। আলাপকালে বললেন, এখন রাস্তাঘাট নির্মাণের কাজ করছি। বন্দরের কার্যক্রম চালু হলে এখানে কাজ আরও বাড়বে। এক সময় কাজের জন্য বাইরে যেতাম। এখন বাইরে থেকে কাজের জন্য লোক আসবে এখানে। এলাকার উন্নয়ন ঘটবে। আমরা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবো।
paira_2
দোকানদার সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এই সমুদ্র বন্দর এলাকার মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। এটা যেন আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো। কেউ কল্পনাও করেনি এই গ্রামের ভেতরে এতকিছু হবে। ছোটখাট ব্যবসা করে এখানে টিকে থাকার মত ব্যবস্থা হয়েছে। এলাকার মানুষ খুবই আনন্দিত।

বছরে অন্তত চার মাস এই এলাকার মানুষ কাজের অভাবে অতিকষ্টে ধার-দেনা করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল। একসময় ঘরের পুরুষ সদস্যদের অনেকে কাজের সন্ধানে শহরে যেতেন। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরে কাজ করে কিছু টাকা-পয়সা নিয়ে তারা গ্রামে ফিরতেন। এসব মানুষের মাঝে এখন কর্মসংস্থান সৃষ্টির নতুন স্বপ্ন। এরা মনে করছেন, জীবিকা নির্বাহে আর কোনো সমস্যা হবে না।
paira_3 
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পায়রা সমুদ্র বন্দরটি এখন পর্যটন কেন্দ্রের মাত্রা পেয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন দর্শণার্থী। পটুয়াখালী জেলা সদর থেকে পর্যটন শহর কলাপাড়া উপজেলা সদর, আর সেখান থেকে সোজা গাড়িতে লোকজন সহজেই যেতে পারেন পায়রা বন্দর এলাকায়। বিকেলে এখানে ভিড় বেড়ে যায়। আসে বহু যানবাহন। কলাপাড়া শহর থেকে রিকশা, হোন্ডা, অটোবাইকের এক নতুন রুটে পরিণত হয় পায়রা বন্দরে যাওয়ার পথটি।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, পায়রা বন্দর নির্মাণ কাজ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে এখানকার সার্বিক চেহারাটাই যেন বদলে গেছে। একসময় এখানকার মানুষ নিজের জমিজমা আবাদে অনীহা দেখালেও সেই জমির এখন তারা স্বর্ণমূল্য হাঁকছেন। এই সুবাদে তাদের আর্থিক দীনতার দিনও যেন শেষ হতে চলেছে। বন্দর এলাকায় অনেকে আগেভাগেই দোকানপাট নিয়ে বসেছেন। অনেকে চিন্তাভাবনা করছেন দূরের ব্যবসা এখানে নিয়ে আসার।
paira_4 
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জান‍ায়, ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময় বহির্নোঙরের কাজ শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া ছোট ভ্যাসেলের মাধ্যমে পণ্য খালাসের মধ্যদিয়ে এই বন্দরের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। রামনাবাদ মোহনা থেকে কাজল, তেঁতুলিয়া নদী হয়ে কালীগঞ্জ পর্যন্ত সমুদ্রের (নৌ-পথের) গভীরতা যাচাইয়ের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে।   অধিকাংশ রুটের গভীরতা সাত থেকে ১৫ মিটার। গভীরতা কিছুটা কম থাকায় শুধু চালিতাবুনিয়াসহ কয়েকটি এলাকায় খনন কাজ করতে হবে।

বন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ইতোমধ্যে কাউয়ারচরে বাতিঘর স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। পায়রা বন্দর থেকে কুয়াকাটাগামী মহাসড়কের রজপাড়া পর্যন্ত চার লেনের মূল সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ বছর লালুয়ার চারিপাড়াসহ আশপাশ এলাকার প্রায় দুই হাজার একর জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চূড়ান্তের পথে। প্রকল্পের এ কাজ করতে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। চারিপাড়ায় মূল বন্দরের কাজ শুরু করতে বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বন্দরে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে। সংযোগ সড়কের কাজ চলছে।
paira_5
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দেশের অন্য সমুদ্র বন্দর থেকে পায়রা সমুদ্র বন্দরের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। অন্য বন্দরে জাহাজ চলাচলে জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করতে হলেও এখানে সেটা হবে না। এ বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করতে পারবে অনায়াসেই। গভীরতা বেশি থাকায় এ রুটে ২৪ ঘণ্টা জাহাজ চলাচলের সুযোগ রয়েছে।

সূত্র বলছে, এই বন্দর এলাকা এক্সক্লুসিভ জোনে পরিণত করার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। নৌবাহিনীকে আধুনিক ও ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে খুব শিগগিরই সাবমেরিন সংযোজিত হতে যাচ্ছে। দেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দরের পাশে স্থাপিত এই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আধুনিক নৌঘাঁটিতে নৌ কমান্ডো, এভিয়েশন, জাহাজ ও সাবমেরিন বার্থিং সুবিধা থাকবে। এই ঘাঁটি দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মধ্যবর্তী হওয়ায় এখান থেকে নেভাল এভিয়েশান কার্যক্রম পরিচালনা করে দেশের বিস্তীর্ণ সমুদ্র এলাকায় নজরদারি রক্ষা করা সম্ভব হবে।
paira_6
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নৌবাহিনীর এই ঘাঁটির মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি সুন্দরবন ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অপরাধ দমনে নৌবাহিনীর বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে পারবে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে সাধারণ জনগণের জানমাল রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

এছাড়া নৌবাহিনী তার নিজস্ব বিভিন্ন অপারেশনাল ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে এ অঞ্চলের জনগণের জন্য সরকারের গৃহীত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারবে। শের-ই-বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের নামানুসারে এই নৌ ঘাঁটির নামকরণ করা হয়েছে ‘বানৌজা শের-ই-বাংলা’।

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০০৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।