ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

বিনামূল্যে আইনি সহায়তা, স্বস্তি ফিরছে তৃণমূলে!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০১৪
বিনামূল্যে আইনি সহায়তা, স্বস্তি ফিরছে তৃণমূলে! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

লালুয়া, কলাপাড়া, পটুয়াখালী ঘুরে এসে : নাম রাশিদা বেগম। স্বামী হেলাল খান।

বাড়ি পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের চর চান্দুপাড়া গ্রামে। রাশিদার কাছে তার স্বামী প্রথমে ৫০ হাজার টাকা যৌতুক দাবি করে। এ দাবি পূরণের পর আবারও ৫০ হাজার টাকা চায়। না দিতে পারায় রাশিদাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে ঘর তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। অবশেষে অসহায় এই নারী বিচার চাইতে এসেছেন।

শুধু রাশিদা একা নন। এমন ঘটনা আছে আরও অনেক। কোনটা যৌতুক সংক্রান্ত, আবার কোনটা নারী নির্যাতনের অন্য কোন কারণ। বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধসহ বিভিন্ন অভিযোগ আসে এখানে। তৃণমূল পর্যায়ের নারী-পুরুষের অভিযোগের ভিত্তিতে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লালুয়া ইউনিয়নে এমনই এক আইনি সহায়তা কেন্দ্রের সন্ধান মিলল। ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষে প্রতি শনিবার পরিচালিত হয় এর কার্যক্রম। এখানে একজন আইনজীবী বসেন। অভিযোগের ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে বিরোধ মিমাংসার চেষ্টা করেন তিনি। মিমাংসায় ব্যর্থ হলে ধাপে ধাপে অভিযোগ গড়ায় আদালত পর্যন্ত। আর এখানে এসে সহায়তা নেওয়ার জন্য সপ্তাহ জুড়ে গোটা ইউনিয়নে বিভিন্ন পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ চলে।

স্থানীয় লোকজন জানালেন, সমুদ্র উপকূলবর্তী এই অঞ্চলে মানুষের অসচেতনতার ফলে পারিবারিক সংকট ছিল অনেক বেশি। যৌতুক, তালাক, বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ, জমিজমা বিরোধের ফলে বিরাজ করতো অস্থিরতা। অশান্তি ছিল ঘরে ঘরে। যৌতুকের দাবিতে স্বামী-স্ত্রী বিরোধের ঘটনা ছিল অসংখ্য। নির্যাতিত স্ত্রী বিচারের দাবি নিয়ে ঘুরতের আদালতের দ্বারে। মামলা ঝুলত বছরের পর বছর। তবুও বিচার পেতেন না। আইনি সহায়তা বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতাও ছিল না।

এখন বেড়েছে। আইনি বিষয়ে তৃণমূলের মানুষ আগের চেয়ে অনেকটাই সচেতন। শুধু প্রকল্প সংশ্লিষ্ট লোকজন নয়, কার্যক্রমের ইতিবাচক প্রভাবের কথা শোনা গেল স্থানীয় বাসিন্দা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের মুখেও। লালুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মীর তারিকুজ্জামান তারা বলেন, আইনি সহায়তা ও এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর কাজের প্রভাব পড়েছে ইউনিয়ন জুড়ে। ইউনিয়ন পরিষদে বিচার-সালিশের চাপ কমেছে।    

প্রত্যন্ত পল্লীর এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যেই তৃণমূল স্তরের মানুষের জন্য আইনি সহায়তা নিশ্চিতকরণের এই প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের নাম সংক্ষেপে কোডেক-সিএলএস প্রকল্প। আর পুরো নাম রাইটস অ্যান্ড লিগ্যাল ক্যাপাসিটি এহ্যান্সমেন্ট অব কোস্টাল সিবিও। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি সংস্থা কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (কোডেক)। যুক্তরাজ্য সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত এবং ম্যাক্সওয়েল স্ট্যাম্প (পিএলসি), ব্রিটিশ কাউন্সিল ও সেন্টার ফর এফেকটিভ ডিসপিউট রেজুলেশন (সিইডিআর)-এর সহায়তায় প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে।

আইনি সহায়তা দিয়ে তৃণমূলের মানুষের মাঝে শান্তি ফিরিয়ে আনা এই প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য বলে জানালেন সংশ্লিষ্টরা। আর ২০১৩ সালের মে মাসে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কার্যক্রমের প্রভাব এরইমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। কলাপাড়া উপজেলায় পরিচালিত একাধিক সিএলএস সেন্টার সরেজমিন ঘুরে এ তথ্য মেলে। অনেকেই পারিবারিক কলহ মেটানোর ভরসা হিসাবে এই সিএলএস সেন্টারকেই দেখছেন।  

কোডেক-সিএলএস প্রকল্পের কলাপাড়া উপজেলা কার্যালয় সূত্র বলছে, অক্টোবর ২০১৪ সময়কালে এই প্রকল্পের আওতায় গোটা উপজেলায় ৫৮৩টি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এবং ১২৬টি অভিযোগ গ্রহন করা হয়েছে। অভিযোগের মধ্যে বেশকিছু সমঝোতা ও আপোষ হয়েছে। এই সময়কালে ২ হাজার ৬৫২টি উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সব মিলে প্রকল্পে সম্পৃক্ত হয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।

কলাপাড়ায় এই প্রকল্পের প্রোগ্রাম অর্গানাইজার দেলোয়ারা বেগম বলেন, প্রকল্পের আওতায় প্রতি মাসে প্রতিটি ইউনিয়নে ১৫টি করে উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে আইনি সহায়তা বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা হয়। বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহের কুফল সম্পর্কে আলোচনা হয়। নারীর অধিকারের বিষয়গুলো আরও সহজ করে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে নারীর পাশাপাশি থাকে পুরুষেরাও। সপ্তাহে একবার প্রত্যেক শনিবার উপজেলার ৯টি আইনি সহায়তা ক্লিনিক বসে। উঠান বৈঠকে অংশগ্রহনকারীরা এখানে এসে তাদের অভিযোগ দেন।

তিনি জানান, অভিযোগ পেয়ে সমঝোতার জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কোনভাবে যোগাযোগ করা সম্ভব না হলে অভিযোগ আদালতে গড়ায়। তবে আদালতে না পাঠিয়ে স্থানীয়ভাবে সমঝোতার চেষ্টাটাই বেশি থাকে। অভিযোগকারীদের অভিযোগ শুনে সমঝোতার জন্য আবার আইনি সহায়তা ক্লিনিকে একজন করে আইনজীবী উপস্থিত থাকেন।  

লালুয়া ইউনিয়ন পরিষদে আইনি সহায়তা ক্লিনিকে কথা হল দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনজীবী নাজমুল আহসানের সঙ্গে। তিনি পটুয়াখালী জজকোর্টের আইনজীবী। প্রকল্প সম্পর্কে তিনি বলেন, যেকোন ঘটনা আমরা উভয়পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে সমঝোতার চেষ্টা করে থাকি। কোনভাবে সমঝোতা না হলে আদালতে পাঠানো হয়। এই কার্যক্রম সাধারণ মানুষকে অনেক উপকৃত করছে। আইনি বিষয়ে মানুষ অনেক সচেতন হচ্ছে।

এই আইনি সহায়তা ক্লিনিকের দায়িত্বে থাকা প্যারালিগ্যাল ভলান্টিয়ার দিলরুবা ইয়াসমিন মিলি বলেন, হতদরিদ্র নারীরাই এখানে বেশি অভিযোগ নিয়ে আসেন। বিশেষ করে যারা টাকার অভাবে আদালতে মামলা করতে পারছেন না, তাদেরকে সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। গত ১১ মাসে লালুয়া ইউনিয়নে ৬৭টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এরমধ্যে ৮টি নিস্পত্তি হয়েছে।

স্থানীয় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সমন্বয় পরিষদ এই কার্যক্রমের সহায়ক হিসাবে কাজ করছে। উঠান বৈঠক আয়োজন কিংবা আইনি সহায়তা ক্লিনিক পরিচালনায় এই পরিষদের সক্রিয় ভূমিকা থাকে। পরিষদের মাসিক সভায় গোটা ইউনিয়নে পারিবারিক কলহের বিষয়গুলো উত্থাপিত হয়। সমঝোতা ও সমাধানের বিষয়েও সেখানেই আলোচনা হয়।  

লালুয়া ইউনিয়ন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি মো. জাকির হোসেন আকন বলেন, তৃণমূলের মানুষের আইনি সহায়তা দিতে এই ভিন্নধর্মী কার্যক্রম এলাকায় নারী নির্যাতন ও পারিবারিক কলহ কমিয়ে নিয়েছে। যৌতুকের দাবিতে নারী নির্যাতন, অহরহ তালাক, বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহের ঘটনা আগের চেয়ে অনেক কম। সমস্যা সমাধানে এলাকার মানুষ একটা নিরাপদ স্থান পেয়েছে।

কোডেক আইন সহায়তা প্রকল্পের চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর অর্চনা পাল বলেন, উপকূলের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে এই আইন সহায়তা প্রকল্প। পটুয়াখালী সদর ও কলাপাড়া উপজেলার ১৩ ইউনিয়ন এবং চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড ও চন্দনাইশ ইউনিয়নের ১৪টি ইউনিয়নের ১ লাখ ৫৪ হাজার পরিবার নিয়ে এই প্রকল্প কাজ করছে।

তিনি বলেন, প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র মানুষের জন্য বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। প্রথমে স্থানীয়ভাবে সমঝোতার চেষ্টা করা হয়। কোনভাবে সম্ভব না হলে জেলা লিগ্যাল এইড কিংবা ব্লাস্ট-এর কাছে পাঠানো হয়। তবে সে ক্ষেত্রে মামলা পরিচালনার খরচ, এমনকি ভূক্তভোগীর যাতায়াত ভাতা পর্যন্ত প্রকল্প থেকে বহন করা হচ্ছে। আইনি সহায়তা পাওয়ায় দরিদ্র মানুষের পরিবারে শান্তি ফিরে আসছে।
     
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০১৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।