দরিয়ানগর, কক্সবাজার থেকে: শেষ বিকেলে পাহাড় থেকে নেমে এসে সমুদ্রের ঢেউয়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে গেল সুর্য। সেই খুশিতে যেন চক চক করে উঠল সমুদ্র।
এ যেন সূর্য, পাহাড় ও সমুদ্রের মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার এক অপরুপ মূহুর্ত। নোনাজলের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে পাহাড়ের পাদদেশে। তার উপর খেলা করছে পড়ন্ত বিকেলে পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যের সোনালী রোদ।
তেজ কমে যাওয়া সূর্যের সোনালী আলোকচ্ছটা দীর্ঘ বেলাভূমিতে সোনা ছড়িয়ে রেখেছে। আবার পাহাড়ের উঁচুতে কাশফুলের সঙ্গে সূর্যের নিবিড় সখ্যতায় সৃষ্টি হয়েছে এক বিশাল ক্যানভাস। আকাশের নীল ক্যানভাসে রঙতুলির কাজ করছে এক ঝাঁক গাঙচিল। তাদের উড়ে চলা সমুদ্রঘেঁষা আকাশের অসীম নীলিমায়।
পাহাড়, সমুদ্র আর সুর্যের মিলনের এ অপরূপ দৃশ্য বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের নিকটবর্তী দরিয়ানগর পর্যটন কেন্দ্রের। কক্সবাজার শহর থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে মাত্র আট কিলোমিটার পূর্বদিকে দরিয়ানগর পর্যটন কেন্দ্র।
পশ্চিমে বিশাল বঙ্গোপসাগর, পূর্বে উঁচু পাহাড়। মাঝখানে কক্সবাজার-টেকনাফ পিচঢালা সড়ক। এই পথ ধরে এগিয়ে গেলেই সবুজে ঘেরা বড়ছেড়া গ্রাম। এই গ্রামের ৫৩ হেক্টর জমির ওপরে উঁচু-নিচু পাঁচটি পাহাড়ের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই বিনোদন কেন্দ্রটি।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে খানিক দূরে হিমছড়ি বা ইনানী বিচে যাওয়ার আগেই সমুদ্র আর পাহাড়ের এই মিলনস্থল। পাহাড়ের চূড়া থেকে প্রায় সাতশ’ ফুট গভীরে একটি প্রাচীন গুহাও রয়েছে এখানে। পর্যটকরা অনায়াসে পাহাড়ের সেই ভিন্ন রূপটা উপভোগ করতে পারেন।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের ভ্রমণ ও আনন্দ খানিকটা বাড়িয়ে দিতে পারে এই দরিয়ানগর। প্রকৃতি তার দু’হাত ভরে সৌন্দর্য বিতরণ করেছে দরিয়ানগরকে।
পর্যটকরা জানালেন, দরিয়ানগরের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়েই বারবার তারা ছুটে আসতে চান এখানে। পাহাড়ের নির্জনতা আর সমুদ্রের বেলাভূমিতে পা ফেলে এক ভিন্ন আনন্দ উপভোগের সুযোগ রয়েছে এখানে।
পর্যটক আর উদ্যোক্তাদের মুখ থেকেই জানা গেল এখানকার নিরাপত্তার কথা। পাহাড়ের জঙ্গলে সরু গলিপথে রয়েছে টুরিস্ট পুলিশের পাহারা। এছাড়া পথ দেখাতে রয়েছে একদল নারী পথ নির্দেশক। পর্যটকদের ভ্রমণ আনন্দ আরও উপভোগ্য করে তুলতে এই পথ নির্দেশকরা সব সময় এখানে থাকেন।
দরিয়ানগরে কর্মরত পথ নির্দেশক সুইটি আকতার জানান, এখানে পর্যটকেরা সম্পূর্ণ নিরাপদ। পাহাড় ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে সরু পথ। মাঝে-মধ্যে বিশ্রামের জন্য তৈরি করা হয়েছে ছোট ছোট ছনের ঘর। পাহাড়ের চূড়ায় স্থাপিত ‘কবি টং’-এ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। এখানে নব দম্পতিদের জন্য মধুচন্দ্রিমার ব্যবস্থাও রয়েছে।
কবিতা ও সাহিত্যের উৎসভূমি পাহাড় ও সমুদ্রে আসেন, কবি ও সাহিত্যিকেরাও। পাহাড়ের নির্জনতা আর সমুদ্রের সুনসান মিলিয়ে লেখক তার কল্পনাকে রুপ দেন কবিতা, উপন্যাস ও গল্পে।
কথিত আছে, আরব থেকে বণিক সওদাগররা জাহাজে করে ব্যবসা করতে আসতেন পূর্বে। একবার বাণিজ্য তরী নিয়ে বঙ্গোপসাগরের এই উপকূলে এসেছিলেন আরবের এক নাবিক শাহেনশাহ। মাঝ নদীতে হঠাৎ ডুবে যায় তার তরী। শাহেনশাহ অনেক কষ্টে সাঁতরে কূলে উঠে এবং দরিয়ানগরের এই পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেন। এ কারণেই এ গুহার নামকরণ করা হয় ‘শাহেনশাহ গুহা’।
দরিয়ানগর পর্যটন কেন্দ্রের হাঙ্গর আকৃতির গেটের হাঙ্গরের মুখের ভেতর দিয়ে ভেতরে ঢুকে লেজের অংশ দিয়ে বের হতে হয়। দূর থেকে দেখে মনে হয় এটা সমুদ্রের জীবন্ত হাঙর। প্রবেশ পথে এক বিশাল আকৃতির কৃত্রিম আজগর যেন পর্যটকদের অভ্যর্থনায় ব্যস্ত। ভেতরে বিভিন্নভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে জিরাফ, কুমির, কচ্ছপসহ আরও কিছু প্রাণীর প্রতিকৃতি। পার্কের এক কোণে দেখানো হয়েছে করাতকল দিয়ে এক শ্রমিক গাছ কাটছে আর গাছ তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছে।
উদ্যোক্তারা জানান, পর্যটকদের রাত্রিকালীন অবস্থানের জন্য দরিয়ানগরে আছে বিভিন্ন রকম কটেজ। মাঝে-মধ্যে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাতায়াতের জন্য বাঁশের সাঁকো পাড়ি দিতে হয়। পাহাড়ের নিচে শাহেনশাহ গুহায় প্রবেশের সময় একটু সতর্ক থাকতে হয়। পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটা-চলায় পা পিছলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বর্ষার সময় সাপের উপদ্রব থাকলেও গ্রীষ্ম ও শীতকালে গুহায় প্রবেশ একেবারেই নিরাপদ।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কখনো কখনো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কবিতা উৎসব হয় এখানে। পর্যটকরাও দলবল নিয়ে এসে আয়োজন করেন নানা রকম অনুষ্ঠানের।
দরিয়ানগরে বন বিভাগের ৫৩ হেক্টর জমি ইজারা নিয়ে ২০০৪ সালে এই থিম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয় কক্সবাজার সি বিচ ক্লাব লিমিটেড। দরিয়ানগর থিম পার্কের প্রধান উদ্যোক্তা ও কক্সবাজার সি বিচ ক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম সায়েম ডালিম বাংলানিউজকে জানান, বন বিভাগের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে নিজস্ব বিনিয়োগের মাধ্যমে এটি পরিচালিত হচ্ছে। ২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত সরকার এই পার্ক থেকে কোটি টাকার বেশি রাজস্ব পেয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় হলেও এখানকার অবকাঠামো নির্মাণে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কোনো উদ্যোগ নাই।
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১৪