ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

অতিরিক্ত ফি, পরীক্ষা দিতে পারল না তাকলিমা

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৫
অতিরিক্ত ফি, পরীক্ষা দিতে পারল না তাকলিমা ছবি: প্রতীকী

সুতরিয়া, ধলঘাটা, মহেশখালী(কক্সবাজার) থেকে: সবজি বা মাছের বাজারে ক্রেতা বা বিক্রেতারা দর কষাকষি করেন সেটা স্বাভাবিক। তাই বলে পরীক্ষার ফরম পুরণের জন্য ফি দেওয়ার সময় দর কষাকষি বিষয়টা ‍খুবই অস্বাভাবিক।



এমনই অভিযোগ উঠেছে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটা ইউনিয়নের ধলঘাটা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
 
একই ইউনিয়নের গুড়িয়াখালী গ্রামের তাকলিমা সোলতানা নামে এক শিক্ষার্থী জানান, বিদ্যালয় কমিটি ও শিক্ষকদের দর কষাকষির কারণে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে পারেনি।

তাকলিমা জানান, নিয়ম অনুযায়ী দুই হাজার নয়শ’ টাকায় ফরম পূরণ করার কথা থাকলেও, তাকলিমার ফরম পূরণের জন্য  ৬ হাজার দুইশ’ টাকা দাবি করে বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন।  

এ প্রসঙ্গে তাকলিমার বাবা মো. বেলাল জানান, নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলে জমির উদ্দিন তাকে ডেকে বলেন তাকলিমা ছয় বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে। এ জন্য তাকলিমার পরীক্ষার ফরম পূরনের জন্য ছয় হাজার দুইশ’ টাকা লাগবে।

এ সময় বেলাল তার মেয়ের ফলাফল দেখতে চাইলে তাকে পরে দেখানো হবে বলে জানান, জমির উদ্দিন।

পরের দিন কমিটির ওই সদস্য আবার বেলালকে বলেন, তার মেয়ে দুই বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে। সেকারণে পরীক্ষার ফি ৬ হাজার দুইশ’ টাকা থেকে কমিয়ে ৩ হাজার দুইশ’ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।       

এরপর বেলাল ধারদেনা করে ওই টাকা জোগাড় করে জমির উদ্দিনের হাতে দেন। কিন্তু জমির উদ্দিন ওই টাকা বিদ্যালয়ে পৌঁছানোর আগেই ফরম পূরণের সময়সীমা শেষ হয়ে যায়। এ কারণে তাকলিমার আর ফরম পূরণ করা হয় নি।    

তাকলিমা জানান, ফরম পূরণের সুযোগ পেতে শিক্ষকদের কাছে ধরনা দিয়েছেন। বিদ্যালয় কমিটির সদস্যদের কাছেও গিয়েছেন কিন্তু পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেলেন না। কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তাকলিমা।

তাকলিমার বাবা বেলাল জানান, অনেক কষ্ট হলেও তৃতীয় সন্তান তাকলিমাকে লেখাপড়া করানোর স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু মাধ্যমিক পেরোনোর আগেই হোঁচট খেল তাকলিমা।

তবে বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বেলালের কাছে অতিরিক্ত টাকা চাওয়া হয়নি। তিন হাজার দুইশ’ টাকা চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু বেলাল সময় মত টাকা না দিতে না পারায় ফরম পূরণ সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা ‍কমিটির সভাপতি মোকতার আহমেদ বলেন, এ ঘটনার জন্য দায়ী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সালেহ আহমেদ।
তিনি বলেন,  নির্বাচনী পরীক্ষার পর বিদ্যালয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় তিন বিষয়ে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

তবে অকৃতকার্য হওয়া প্রতি বিষয়ের জন্য দুইশ’ টাকা করে জরিমানা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সভার এ সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা হয়নি। প্রধান শিক্ষক তার ইচ্ছা অনুযায়ী ফরম পূরণের জন্য কারও কাছ থেকে তিন হাজার পাঁচশ’ টাকা, কারও কাছ থেকে চার হাজার আবার কারও কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন, মোকতার আহমেদ।

স্থানীয় লোকজন জানান, বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির গাফিলতি ও অতিরিক্ত ফি আদায়ের চক্রে পড়ে দরিদ্র পরিবারের সন্তান তাকলিমা সোলতানা পরীক্ষায় অংশ নিতে পারলনা। প্রথম থেকেই তাকলিমার বাবা বেলালকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ধলঘাটা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সালেহ আহমদ বলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য নয়, বরং তাকলিমার ফরম পূরণ করতে না পারার জন্য তার অভিভাবকই দায়ী। ফরম পূরণের সময় শেষ হওয়ার পর বেলাল তার মেয়ের ফরম পূরণের জন্য এসেছেন।

এদিকে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, ধলঘাটা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণে চরম অনিয়ম হয়েছে। ফি নেওয়ার বিষয়ে শিক্ষা বোর্ডের আদেশ সরাসরি আসে স্কুলে।

শিক্ষা বিভাগের কেন্দ্রীয় দপ্তর কিংবা স্থানীয় শিক্ষা দপ্তরে এ বিষয়ে কোন নির্দেশনা নেই। ফলে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির ইচ্ছাতেই নির্ধারিত হয় ফরম পূরণের অংকের পরিমাণ।

এলাকাবাসী জানান, কমিটির সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ থাকায় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তার ইচ্ছা অনুযায়ী টাকা নেন।

এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক সালেহ আহমদ জানান,  চলতি শিক্ষা বছরে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের ক্ষেত্রে সরকারি খাতে জমা দেওয়ার জন্যে এক হাজার চারশ’ টাকা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৩০ টাকা পরীক্ষার ফি আর তিনশ’ ৫০ টাকা খরচ বাবদ।

এর সঙ্গে কোচিং ফি এক হাজার দুইশ’ টাকা এবং কেয়ারিং ফি তিনশ’ টাকা যোগ করেছে বিদ্যালয় কমিটি। এছাড়া নির্বচনী পরীক্ষার ফলাফলের ওপর কিছু বাড়তি ফি যোগ করা হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা অভিযোগ করেছেন, ধলঘাটা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে এবার তিন বিষয়ে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতি বিষয়ের জন্য দুইশ’ টাকা করে অতিরিক্ত ফি আদায় করা হয়েছে। শুধু তাই নয় ৩টির বেশি বিষয়ে অকৃতকার্য হলে আরো বেশি টাকা আদায় করেছে কর্তৃপক্ষ।

এদিকে কমিটির সদস্যরা বলেছেন, অভিভাবকদের অনুরোধে নির্বাচনী পরীক্ষায় খারাপ করার পরও শিক্ষার্থীদের অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এজন্য বাড়তি কিছু ফি নেওয়া হয়েছে।

মহেশখালী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার (অতিরিক্ত) দায়িত্বে থাকা কক্সবাজার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন বলেন, শিক্ষাবোর্ডের নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত কোন ফি নেওয়ার কথা নয়। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]

বাংলাদেশ সময়: ০৮২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।