মগডেইল, মাতারবাড়ি, মহেশখালী (কক্সবাজার) ঘুরে এসে: ভরা লবণ চাষের মৌসুমেও কর্মহীন মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকার হাজার হাজার মানুষ।
বিশাল মাঠে চলতি মৌসুমে লবণ চাষ না হওয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত ২০ হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন।
কাজের অভাবে এখন প্রতিটি ঘরেই হাহাকার। তারা পার করছেন চরম দুঃসময়।
মাতারবাড়ি ইউনিয়নের মগডেইলে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা ঘুরে সেখানকার মানুষের কষ্টের কথা তুলে ধরেছে বাংলানিউজ।
ক্ষতিগ্রস্তরা জানিয়েছেন, এখানে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে এলাকাবাসীর কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু জীবনের শেষ সম্বল জমিটুকু হারিয়েও ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি জমির মালিকরা।
এদিকে তাদের বিকল্প কোনো কাজের সুযোগ তৈরি না হওয়ায় এলাকায় কাজের সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
মাতারবাড়ির কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পটি স্থাপন করা হচ্ছে ইউনিয়নের মগডেইল গ্রামে। আর এ কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য গ্রামের প্রায় সব মানুষের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কাজ ও খাবারের খোঁজে গ্রামের অন্তত ১০ হাজার মানুষ এলাকা ছেড়ে শহরে চলে গেছেন। গ্রামের অধিকাংশ মানুষের ঘরে ঠিকভাবে তিনবেলা খাবার জুটছে না। কেউ দু’বেলা আবার কেউবা একবেলা খাবার জোটাতেও হিমশিম খাচ্ছেন। গ্রামে ধারকর্জ দেওয়ার মতো কোনো লোক নেই।
এলাকাবাসী জানান, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য অধিগ্রহণ করা এক হাজার ৪শ’ ১৪ একর জমিতে এখানকার মানুষ লবণ ও চিংড়ি ঘের করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। এলাকার অন্তত ২০ হাজার মানুষের জীবন যাপনের প্রধান উপায় ছিল লবণ ও চিংড়ি চাষ করে।
ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকরা অধিগ্রহণ করা এসব জমির দাম না পাওয়ায় সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। তারা বিকল্প কোনো কাজে যেতেও পারছেন না।
লবণ চাষী ও ব্যবসায়ী আবদুল কাদের (৩৮) জানান, এক মেয়ে ও চার ছেলে নিয়ে সাতজনের সংসার তার।
প্রকল্প এলাকায় প্রায় পাঁচ একর জমি চলে গেছে আব্দুল কাদেরের। এ জমি থেকে তার মাসিক আয় হতো প্রায় ৪০ হাজার টাকা। এখন তার হাতে কোনো কাজ নেই। কিছু টাকা ধার করেছেন। পাঁচটি গরু ও স্বর্ণালংকার বিক্রি করে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
আবু মুসা (২৮) নামে আরেকজন জানান, অন্যের জমি বর্গা নিয়ে লবণ ও চিংড়ি চাষ করতেন। চিংড়ি ঘেরে বিনিয়োগ করেছিলেন ২৫ হাজার টাকা। এটাই ছিল মুসার জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায়। এ থেকে তার মাসিক আয় হতো ১৫ হাজার টাকা।
তবে এখন তার রোজগারের সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দেওয়াই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য।
আহম্মদ হোসেন জানান, পাঁচ একর জমিতে লবণ চাষ করতেন। এখান থেকে মাসে তার আয় হতো অন্তত ২০ হাজার টাকা। এখন তার কোনো রোজগার নেই। ক্ষতিপূরণের আবেদন করা হলেও এখনো পাওয়া যায়নি।
আবদুল মান্নান জমি বর্গা নিয়ে লবণ চাষ করে মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকা আয় করতেন। কিন্তু পাঁচ মাস ধরে কোনো রোজগার নেই। ছোট ব্যবসা নিয়ে বসেছিলেন, তাও বন্ধ হয়ে গেছে। এলাকায় লোকজন নেই বলে বেচাকেনায় ভাটা পড়েছে।
জাহাঙ্গীর আলম দীর্ঘদিন ধরে লবণ চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। লবণ চাষের জমি ছিল দুই একর। শুধু তাই নয়, মাছ চাষের পুকুরও ছিল একটি। এখন পুরোটাই চলে গেছে প্রকল্পের অধীনে। কোনো রোজগার তো নেই, উপরন্তু ঘরে রাখা স্বর্ণও বন্ধক রেখেছেন।
এমন বিপন্ন জীবনের গল্পের কোনো অভাব নেই কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকার আশপাশে। মগডেইল গ্রামের হাজী মোহাম্মদ ইসমাইল, আলতাফ হোসেন, মোহাম্মদ হোসেন, আবু বকর, নূরুল আলম, জসিম উদ্দিন, আলী আজগর, লাল মিয়া, ফজলুল করিম, ওবায়দুল্লাহ, মিজানুর রহমান, সাইরার ডেইল গ্রামের ইউনুস মিয়া, মোস্তাফিজুর রহমান, আহসান আলী, এমরান হোসেনসহ বহু নাম লেখা হয়েছে সহায় সম্বলহীনের খাতায়।
তাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখা গেল, সবার দাবি তাদের কষ্টের কথা যেন লিখে প্রকাশ করা হয়।
স্থানীয় সূত্র বলছে, গত ডিসেম্বরে লবণ চাষের ভরা মৌসুম ছিল। এ সময়ই মানুষের হাতে কাজ থাকার কথা। লবণ মাঠ থাকার কথা জমজমাট। কিন্তু প্রকল্প এলাকার আওতাভুক্ত বিশাল লবণের মাঠ খাঁ খাঁ করছে। পড়ে রয়েছে বিরান।
কাজ না থাকায় এ এলাকার মানুষদের জীবনে নেমে এসেছে চরম সঙ্কট। অনেকে ধারদেনা করে চলছেন। অনেকে ঘরে গচ্ছিত অলংকার, গরু-ছাগল কিংবা ঘরের আসবাবপত্র বিক্রি করে সংসারের খরচ চালাচ্ছেন।
প্রকল্প এলাকার ভেতরে থাকা বেশকিছু বাড়িঘরে বিপন্ন মানুষের দেখা মেলে। দিন আনা দিন খাওয়া এইসব মানুষ তিনবেলা ঠিকমত খেতে পারছেন না।
মগডেইল গ্রামের বাজারের চায়ের দোকান, হোটেল রেস্টুরেন্টে বসলে কিংবা পাড়ার ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলেও কষ্টের জীবন ধারণের বিষয়টি আঁচ করা যায়। এ বাজারের বহু দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীদের মোটা অংকের বকেয়া পড়ে যাওয়ায় তারা দোকান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ব্যবসায়ীসহ সাধারণ লবণ চাষী ও শ্রমিকদের অনেকেই পরিবার পরিজনসহ চট্টগ্রাম শহরে চলে গেছেন বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, কাজ না থাকায় এ এলাকায় হাহাকার বিরাজ করলেও এ বিষয়ে সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য খাতে ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
অথচ প্রভাবশালী চিংড়ি ঘের মালিকেরা কারসাজির মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রায় ২৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এরইমধ্যে তাদের জালিয়াতি প্রশাসনের কাছে ধরা পড়ায় এদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি এলাকাবাসীর।
মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকার মানুষেরা বলছেন, এলাকবাসী এ প্রকল্পের বিরোধিতা করছে না। তবে তারা জমির অ্যাওয়ার্ড মানিসহ সব ধরনের ক্ষতিপূরণ ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্পে কাজের সুযোগ চান।
একই সঙ্গে তারা ক্ষতিপূরণের টাকা তোলা নিয়ে কুচক্রী মহলের অপতৎপরতা রোধে প্রশাসনিক কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকার এ সঙ্কট নিয়ে মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ারুল নাসের বলেন, মাতারবড়ির বিষয়টি সরকারের উর্ধ্বতন মহল অবহিত রয়েছেন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected] ]
বাংলাদেশ সময়: ০৭২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৫