ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

সুপেয় পানির সংকট

তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে আইলা কবলিতরা

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২৩ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৫
তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে আইলা কবলিতরা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

গাবুরা, পদ্মপুকুর, মুন্সীগঞ্জ থেকে ফিরে (সাতক্ষীরা): ছবি তুইল কি হবে? শুধু ছবি তুইলি নিয়ে যায়, পানির সমস্যা তো মেটে না। এক কলস পানির জন্যি তিন মাইল দূরিত্বে আসতি হয়, লাইনি দাঁড়াতি হয় চার/পাঁচ ঘণ্টা।

তাতেও পানি পাওয়া যায় না।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার আইলা কবলিত ফুলতলা গ্রামের একটি পিএসএফ-এ (পন্ড স্যান্ড ফিল্টার) দেড় শতাধিক কলসের লাইন দেখে ছবি তুলতে গেলে এভাবেই খাবার পানির তীব্র সংকটের কথা তুলে ধরেন পাশের আবাদচন্ডীপুর গ্রাম থেকে পানি নিতে আসা বৃদ্ধা ফিরোজা খাতুন।

তিনি জানান, সুপেয় পানির অভাবে তীব্র অপুষ্টি বাসা বাঁধছে স্থানীয়দের শরীরে।

প্রায় একই অবস্থা উপকূলজুড়ে। খাবার পানির তীব্র সংকটে সর্বত্র চলছে হাহাকার। চারদিকে পানি থৈ থৈ করলেও তা পানযোগ্য নয়।

শ্যামনগর উপজেলার আইলা কবলিত মুন্সীগঞ্জ, গাবুরা, পদ্মপুকুর ও বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, আইলা আঘাত হানার পর ছয় বছর অতিবাহিত হলেও আইলা কবলিত এলাকায় কাটেনি খাবার পানির সংকট। বরং বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে গোটা উপকূলজুড়ে খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বেঁচে থাকার তাগিদে বাধ্য হয়ে মানুষকে কিনে খেতে হচ্ছে পানি। অনেক এলাকায় আইলায় ডুবে যাওয়া মিষ্টি পানির পুকুর ও জলাশয় এখনো লবণাক্ততা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

আবার অনেক এলাকায় একাধিকবার পুনঃখননের পর পুকুর কিংবা জলাশয় বা রেইন হারভেস্টিংগুলো ব্যবহার উপযোগী হলেও অনাবৃষ্টিতে খাবার পানির জন্য সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষ। নেই গবাদি পশু ও জীবজন্তুর পানযোগ্য পানিও। একদিকে অনাবৃষ্টি, অন্যদিকে লবণাক্ততা- এ দুইয়ে মার খাচ্ছে ফসল-ফলাদিও। বাড়ছে রোগ-শোক, পুষ্টিহীনতা।

আগে বাড়ির আঙিনায় চাষকৃত শাক-সবজি স্থানীয়দের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখলেও আইলার পর লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও লবণ পানি তুলে চিংড়ি চাষের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় তা আর হচ্ছে না। স্থানীয় খালগুলোতে লবণ পানি তোলায় সম্ভব হচ্ছে না কৃষি আবাদও।

একই সঙ্গে মিঠা পানির জলাশয়গুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এলাকার মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে সুপেয় পানি পানের অধিকার থেকে।  

স্থানীয়রা জানান, এলাকার বেশিরভাগ মানুষের বাইরে থেকে পুষ্টিকর খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। আগে বাড়িতে সবজি চাষ ও হাস-মুরগি পালন করতো। কিন্তু মাটি লবণাক্ত হয়ে যাওয়ায় এখন আর সে সুযোগ নেই। এতে নারী ও শিশুরা তীব্র অপুষ্টির শিকার হচ্ছে।

গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা গ্রামের কৃষক আবু মুছা বাংলানিউজকে বলেন, পানির অভাবে মিষ্টি পানির পুকুরগুলো শুকিয়ে গেছে। মানুষ খাওয়ার পানি পাচ্ছে না। অনেকে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে খায়, তাও ফুরিয়ে যাওয়ার পথে। বাধ্য হয়ে প্রতি ড্রাম পানি ৩০ টাকায় কিনে খাচ্ছে মানুষ। অনেক সময় না খেয়েও থাকতে হয়। সুপেয় পানির সংকটে এলাকায় ডায়রিয়া, আমাশয়, চর্ম রোগ ও অপুষ্টি লেগেই থাকে।

চকবারা গ্রামের রাশিদা জানান, পাশের ডুমুরিয়া গ্রামের মাওলানা বাড়ির পুকুর থেকে খাওয়ার পানি নিয়ে আসেন তিনি।

বলেন, এলাকায় কিছুই নেই। পুকুরগুলো হা হা করছে। কাজ নেই, খাবার নেই, পানি নেই। বেঁচে থাকবো কিভাবে?

গাবুরা গ্রামের কৃষক সিদ্দিক গাজী বলেন, এলাকার লবণাক্ততা কমাতে লবণ পানির চিংড়ি চাষ বন্ধ করতে হবে। খালগুলো ইজারা না দিয়ে বৃষ্টির পানি ধরে স্থানীয় জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। তাহলে ফসলও ফলবে, মানুষ দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারও করতে পারবে। এলাকায় কাজও বাড়বে। এতে মিঠা পানির পুকুরগুলো সুরক্ষিত হবে। মানুষ খাওয়ার পানি পাবে।

পদ্মপুকুর ইউনিয়নের চন্ডিপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রভাইডার তনুশ্রী রপ্তান বাংলানিউজকে জানান, পানির সমস্যার কারণে এলাকার মানুষের মধ্যে ডায়রিয়া, আমাশয়, চুলকানি লেগেই থাকে। এছাড়া অপুষ্টিজনিত সমস্যার কারণে নতুন প্রজন্মের মধ্যে খর্বকায় ও কৃশকায় সমস্যা বাড়ছে।

গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রভাইডার হেলেনা বিলকিস বাংলানিউজকে জানান, এখানকার বেশিরভাগ মানুষ রক্ত শূন্যতায় ভুগছে। পুষ্টিকর খাদ্য ও সুপেয় পানির অভাবে গাবুরার মানুষের মধ্যে সবসময় বিভিন্ন রোগ লেগেই থাকে।

যেসব নারী নদী বা ঘেরে মাছ ধরে, তাদের চুলকানি ও সাদা স্রাবের সমস্যাও বেশ, যোগ করেন তিনি। এখানকার নারী ও শিশুরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।

গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম সুপেয় পানি সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, প্রকৃতি আমাদের বিরুদ্ধে। আমরা সব সময় চেষ্টা করি। কিন্তু অধিকাংশ স্থানে টিউবওয়েলগুলো মিষ্টি পানি উত্তোলনে ব্যর্থ হয়। এরপরও বৃষ্টি হলে মানুষ কিছুটা উপকৃত হয়। কিন্তু প্রায়ই অনাবৃষ্টির কারণে খাবার পানিও জোটে না, ফসলও ফলে না।

এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের শ্যামনগর উপজেলা উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, শ্যামনগরের উপকূলীয় এলাকায় সারা বছর সুপেয় খাবার পানির সংকট থাকে।
 
সংকট কাটানোর জন্য সাধারণত পন্ড স্যান্ড ফিল্টার ও রেইন হারভেস্টিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তাতে বছরের মাত্র তিন/চার মাস পানি পাওয়া যায়। আর শুষ্ক মৌসুমসহ অন্যান্য সময় খাবার পানির তীব্র সংকট থাকে। এই সময়ে খাওয়া থেকে শুরু করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা-সব ক্ষেত্রেই লবণ পানি ব্যবহার করা হয়। এতে সারা বছরই অপুষ্টিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয় আইলা কবলিতরা।

তিনি বলেন, পদ্মপুকুর ও গাবুরার পন্ড স্যান্ড ফিল্টার ও রেইন হারভেস্টিং সিস্টেমগুলোর প্রায় ৫০ ভাগ অকেজো হয়ে পড়েছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে যেসব তৈরি করে দেওয়া হয়, স্থানীয়রা পরে আর সেগুলো সংস্কার করে না।

এখানে স্থায়ী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়। যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তা তিন/চার মাসের বেশি টেকসই নয়। যখন বৃষ্টি হয় তখন কাজে লাগে, বৃষ্টি না হলে অকেজো হয়ে পড়ে থাকে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ০১২২ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৫
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।