ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলের শিশু-৫

জলবায়ু পরিবর্তনে দুর্যোগ ঝুঁকিতে শিশুরা

সুমন সিকদার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৪৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৬
জলবায়ু পরিবর্তনে দুর্যোগ ঝুঁকিতে শিশুরা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

[কখনো জেলে, কখনো কৃষক, কখনো বা কঠোর পরিশ্রমী দিনমজুর। দারিদ্রের যাতাকলে নিষ্পেষিত জীবন।

শিক্ষা যেখানে আমাবশ্যার চাঁদ। দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে নিয়তি যাদের নিয়ে যায় হাড়ভাঙা কর্মে। শিশু সুরক্ষার কথা ওরা জানে না, অধিকারের বার্তা ওদের কাছে অর্থহীন। খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকাই জীবনের সার কথা। শৈশব থেকেই বিবর্ণ কর্মজীবনের সূচনা। যেখানে জন্ম থেকেই ঘৃণা আর অবহেলায় বেড়ে ওঠে কন্যা শিশুরা। অপরিণত বয়সেই বিয়ে, অতঃপর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মা ও শিশু। দুর্যোগ ঝুঁকি যাদের নিত্যসঙ্গী। উপকূলীয় প্রান্তিক শিশুদের অন্তহীন দুর্দশার এই চিত্র তুলে এনেছে বাংলানিউজ। বরগুনা করেসপন্ডেন্ট সুমন সিকদারের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ পড়ুন পঞ্চম পর্ব। ]

উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে: জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে সমান্তরালে পাল্লা দিয়ে উপকূলীয় এলাকায় বাড়ছে দুর্যোগের ঝুঁকি। দুর্যোগ মৌসুমে উপকূলবাসী নানান ঝুঁকি নিয়ে তটস্থ থাকলেও তাদের সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা পরিবারের শিশুদের নিয়ে।

উপকূলের যেকোনো দুর্যোগেই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে  শিশুরা। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে খাবার ও বিশুদ্ধ পানীয় জল, নিরাপদ আশ্রয় নিয়ে শিশুদের ভোগান্তি তাই অনেক বেশি।

সারাবিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাবের তালিকায় থাকা ওপরের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আর জলবায়ু পরিবর্তনের এ ক্ষতিকর প্রভাবের অসহায় শিকারে পরিণত এদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রান্তিক শিশুরা। সম্প্রতি বিশ্বের পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ধারণা জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে ধারণার চেয়েও বেশি ঝুঁকিতে পড়বে উপকূলীয় শিশুরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলার ৮৭টি উপজেলার মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল সরাসরি ভোগ করছে। ফলে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় এসব এলাকার শিশুরা থাকে সবচেয়ে ঝুঁকিতে। নদীভাঙন বা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় আবাদি ফসল নষ্ট যেকোনো ঘটনার প্রভাবেই তাই বয়স্কদের চেয়ে শিশুদের ভোগান্তি বেশি।

এ বিষয়ে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদের ডিন আ খ ম মোস্তফা জামান বাংলানিউজকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইদানীংকালে খুব বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা নয় তখনও বৃষ্টি হচ্ছে এদেশে। জলবায়ুর এই আমূল পরিবর্তনে অভিযোজন করতে গিয়ে বেশি দুর্যোগের কবলে পড়ছে শিশুরা। জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার দৈনন্দিন অনুষঙ্গগুলোর গুণগত মান খারাপ করে দেয়। ফলে শিশুরা নানারকম স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মুখে পড়ে।

এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখনই জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রতিরোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আগামী ২০ বছরে শতকরা ৩২০ ভাগ বাড়বে। পাশাপাশি বাড়বে শিশুমৃত্যুর হারও।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকার মানুষ আর্থসামাজিক নানা সমস্যায় ভুগছেন। নানা অপ্রতুলতায় সেসব এলাকার মানুষজন বিশেষ করে শিশুরা পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বরগুনা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা ফারুক হোসেন বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় প্রাণে বাঁচার জন্য যেসব পন্থা অবলম্বন করতে হয় তার বেশিরভাগই শিশুদের অজানা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হলে চাই সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ।

সম্প্রতি সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারাবিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১৭ কোটি ৫০ লাখ শিশু ক্ষতির শিকার হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ডায়রিয়া, অপুষ্টি ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। এসব রোগের সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে উপকূলীয় শিশুরা।

প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে কেবল ভারতেই প্রতিবছর ৫ বছর বা এর কম বয়সী প্রায় ২০ লাখ শিশু নানা রকম রোগে মারা যাচ্ছে। ভারতে এই শিশুমৃত্যুর হার বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ।

তবে আশার কথা বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে দুর্যোগ সচেতনতা গড়ে তুলতে উপকূলজুড়ে কাজ করছে ‘আলোকযাত্রা দল’। দুযোর্গ সচেতনতায় স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে সংগঠনটি বের করছে দেয়াল পত্রিকা ‘বেলাভূমি’। বেলাভূমির মাধ্যমে এ অঞ্চলের শিশুরা দুর্যোগের ঝুঁকি, এর মোকাবেলার উপায় ও  জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল সম্পর্কে জানতে পারছে।

এ বিষয়ে বরগুনা সোনাখালী বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আলোকযাত্রা দল সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক রেইজিনা ইয়াসমিন বলেন, এ ঝুঁকি থেকে শিশুদের রক্ষায় যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও বেসরকারি সংগঠনগুলোকে আরো তৎপর হতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ের আলোকযাত্রা দল গঠন করে ও বেলাভূমি দেয়াল পত্রিকা বের করা হয়েছে, তা শিক্ষার্থীদের জন্য দুর্যোগ সচেতনতায় একটি বড় পদক্ষেপ।

যোগাযোগ করা হলে বরগুনার জেলা প্রশাসক মীর জহুরুল ইসলাম বলেন, বরগুনা উপকূলীয় জেলা হওয়ায় এখানে দুর্যোগ ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। তাই এখানকার শিশুদের যদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন করা গেলে তারা ভবিষৎ দুর্যোগ মোকাবেলায় এগিয়ে থাকবে। তাই শিশুদের দুর্যোগ সচেতনতার পাশাপাশি সঠিক প্রশিক্ষণ দিয়ে দুর্যোগ মোকাবেলায় শক্তিশালী করে তোলা উচিত।

বাংলাদেশ সময়: ০১৪৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৬
এসআর/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।