ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলের শিশু-০৭

অপরিণত বয়সে বিয়ে, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে মা-শিশু

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৬
অপরিণত বয়সে বিয়ে, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে মা-শিশু ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

[কখনো জেলে, কখনো কৃষক, কখনো বা কঠোর পরিশ্রমী দিনমজুর। দারিদ্রের যাতাকলে নিষ্পেষিত জীবন।

শিক্ষা যেখানে আমাবশ্যার চাঁদ। দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে নিয়তি যাদের নিয়ে যায় হাড়ভাঙা কর্মে। শিশু সুরক্ষার কথা ওরা জানে না, অধিকারের বার্তা ওদের কাছে অর্থহীন। খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকাই জীবনের সার কথা। শৈশব থেকেই বিবর্ণ কর্মজীবনের সূচনা। যেখানে জন্ম থেকেই ঘৃণা আর অবহেলায় বেড়ে ওঠে কন্যা শিশুরা। অপরিণত বয়সেই বিয়ে, অতঃপর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মা ও শিশু। দুর্যোগ ঝুঁকি যাদের নিত্যসঙ্গী। উপকূলীয় প্রান্তিক শিশুদের অন্তহীন দুর্দশার এই চিত্র তুলে এনেছে বাংলানিউজ। বরগুনা করেসপন্ডেন্ট সুমন সিকদারের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ পড়ুন সপ্তম পর্ব। ]

উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে: উপকূলের অধিকাংশ পরিবারে নিত্য অভাব-অনটন লেগেই আছে। আর্থিক টানাপোড়েনের শিকার এসব দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে এখানকার অমোঘ নিয়ম।

উপকূলীয় এলাকায় মেয়েদের সাধারণ ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যেই বিয়ে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে অনেকটাই দায়মুক্ত হতে চান বাবা-মা।

ফলে অপরিণত বয়সের এ বিয়ের কারণে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভোগেন এ অঞ্চলের বাসিন্দারা, বিশেষ করে অল্প বয়সে বিয়ে ও গর্ভধারণের কারণে নারীরা ব্যাপকহারে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। মায়ের কারণে অপুষ্টি, বিকলাঙ্গতাসহ নানা সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের শিশুদের।

এমনকি, বাল্যবিয়ের কারণে বিচ্ছেদ ও মৃত্যুও এখন হরহামেশাই ঘটছে উপকূলে। সংসারেও দেখা দিচ্ছে নানান সমস্যা।

বরগুনা সদর উপজেলার বড় গৌরিচন্না আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দা মোসা. ফুর্তি বেগম (১৬)। ৫ বছর আগে মাত্র ১১ বছর বয়সে বিয়ে হয় সদর উপজেলা আড়পাঙ্গাশিয়া গ্রামের ২৫ বছর বয়সী আলমগীর হোসেনের সঙ্গে। ৩ বছরের একটি ছেলে রয়েছে তার। তবে ছেলেটি প্রতিবন্ধী।

ছেলে প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে উঠতে-বসতে কথা শুনতে হয় ফুর্তি বেগমকে। কখনো কখনো সইতে হয় শারীরিক  নির্যাতনও।

ফুর্তি বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ‘যহন হক্কোলে স্কুলে যায় হেই সময় মুই স্বামীর সংসারে গেছি। মোনে চাইতো পড়ালেহা হরমু, কিন্তু বাপ-মায় বিয়া দিয়া দিলো। স্বামীর সংসারে প্রতিদিন বেয়াগ কাম হরি, তারপরও শান্তি নাই। উঠতে-বসতে অপয়া-অলক্ষ্মী কথা শুনতে হয়। ছেলেটার জন্ম হইছে প্রতিবন্ধী হিসেবে। এই লাইগ্যা হক্কোলেই মোরে দায়ী করে। কই যামু, যাওয়ার কোনো পথ নাই। ’

স্থানীয় আরেক গৃহবধূ রেবিন আক্তারের বিয়ে হয় ১২ বছর বয়সে। বিয়ের কিছুদিন পর স্বামী আরেকটি বিয়ে করে তাকে তালাক দিয়েছেন। একমাত্র সন্তান নিয়ে স্বামীর সংসার থেকেও বিতাড়িত হয়েছেন তিনি। তাই বাধ্য হয়ে বাড়ি-বাড়ি ঝিয়ের কাজ করতে হচ্ছে তাকে। এমনকি, ছোট্ট ছেলেটার অসুখ-বিসুখে ডাক্তার দেখানোর মতোও সামর্থ্য নেই তার।

উপকূলের মানুষকে নিয়ে কাজ করা স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কার ফোরাম ২০১৫ সালের মে মাসে ইউনিসেফ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে।

ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ের ও একই বয়সের ৫ শতাংশ ছেলের বিয়ে হয়। এছাড়া দেশের ১০-১৯ বছর বয়সের দুই-তৃতীয়াংশ মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই ৩৯ শতাংশ ও ১৮ বছরের মধ্যে ৭৪ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়। ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের এই হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। যেখানে প্রতিবেশী দেশ ভারতে বাল্যবিয়ের গড় হার ৫০ শতাংশ, নেপালে ৫৭ শতাংশ এবং আফগানিস্তানে ৫৪ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম বয়সী বিবাহিত মেয়েদের ২০ শতাংশ ২৪ বছর বয়সের আগেই দুই বা ততোধিক সন্তানের মা হন। ফলে দেশে প্রসূতি মৃত্যুর হার ও অপুষ্টিজনিত সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এসব বিষয়ে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. মো. মুজিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, একজন পূর্ণবয়স্ক মায়ের চেয়ে অপরিণত বয়সে মা হওয়ায় প্রসবকালীন ঝুঁকি দ্বিগুণ থাকে। ১৮ বছরের কম বয়সে অন্তঃসত্ত্বা হলে গর্ভপাতসহ প্রসবকালীন মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে সবচেয়ে বেশি।

তিনি বলেন, কমবয়সে গর্ভধারণ করায় প্রসূতির শরীর ভেঙে যায়। নিজেকে বোঝার মতো উপলদ্ধির আগেই মেয়েরা দুই থেকে তিন বাচ্চার মা হওয়ার ফলে তাদের মানসিক ও  শারীরিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। তাই এসব মায়েদের জন্ম দেওয়া সন্তান অনেকক্ষেত্রেই মানসিক ও শারীরিক সমস্যা নিয়ে জন্ম নেয়।

তিনি আরো বলেন, অপরিণত বয়সে মা হওয়ার ফলে মায়েদের জরায়ু ক্যান্সারও হতে পারে। তাই কিশোরীদের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। এছাড়া বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একত্রিত হয়ে গণসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

মানবাধিকার কমিশন জেলা কমিটির সভাপতি অ্যাড. মোস্তফা কাদের বাংলানিউজকে বলেন, বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনের সর্বোত্তম ব্যবহার ও আমাদের সচেতনতাই পারে বাল্যবিয়ে  হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে।

বাংলাদেশ সময়: ০০৪২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৬
এসআর/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।