পাথরঘাটা (বরগুনা থেকে): ‘টিউবয়েলের পানিতে লবণ আর পাথর, সাপ্লাইয়ের লাইন নষ্ট- পানি ওডে না। মোগো ভাই অনেক কষ্ট’- বলছিলেন মো. শহিদুল ইসলাম্।
মাথায় পানির বড় কলস দেখিয়ে শহিদুল জানালেন, এই গ্রামের পাঁচ হাজার মানুষ ভোর থেকে রাত পর্যন্ত গভীর রাত পর্যন্ত ওই পুকুর থেকে পানি এনে খায়। আধা কিলোমিটার দূরের ওয়াপদার (বেড়িবাঁধ) সাইড এমনকি তারও অনেক দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ আসে পানি নিতে। এর সঙ্গে ফিটকিরি মিশিয়ে খাওয়া-গৃহস্থালির কাজের উপযোগী করে নিতে হয়।
বিষখালী-বলেশ্বর পাড়ের বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার সদর ইউনিয়নের হরিণঘাটা গ্রামের চিত্র এটি।
সিডর বিধ্বস্ত উপজেলাটির অদূরে বঙ্গোপসাগর-পায়রারও মোহনা। পশ্চিমে বলেশ্বর নদের ওপাড়ে সুন্দরবন। উপকূলীয় পাথরঘাটাকে ঘিরে রেখেছে ১১৭ কিলোমিটারের বেড়িবাঁধ। সব মিলিয়ে নদী-সাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশিকে কেন্দ্র করেই এ উপজেলার দুই লক্ষাধিক মানুষের জীবনযাপন।
অথচ পানির দেশের এই মানুষেরাই পান না বিশুদ্ধ খাবার পানি। ধোয়া-মোছা, গোসল, পায়খানা, গবাদিপশুর যত্ন-আত্তি, সবই চলে লবণাক্ত-দূষিত পানিতে। ফলে সারা বছর ভুগতে হয় ডায়রিয়া-আমাশয়-চর্মসহ পানিবাহিত নানা রোগে, স্বাস্থ্য সংকট এখানকার সাধারণ সমস্যা।
বাধ্য হয়ে গ্রামের পর গ্রামের গৃহবধূ, কিশোর-কিশোরী, এমনকি বৃদ্ধ-শিশুদেরকেও মাইলের পর মাইল হেঁটে গিয়ে পুকুরসহ মিঠা পানির জলাশয় থেকে জোগাড় করে আনতে হয় পানি।
এ যেন পানির দেশে পানির আকাল!
সরেজমিনে হরিণঘাটা ও লালদিয়ার চর ছাড়াও সদর ইউনিয়নের পদ্মা, চরলাঠিমারা, জিনতলা, তাফালবাড়িয়া, কালমেঘা ও কাকচিড়া ইউনিয়ন সদর, কাঁঠালতলী ইউনিয়নের পড়িঘাটা এবং চরদুয়ানি ইউনিয়নের দক্ষিণ চরদুয়ানি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ভোরের আলো ফোটার আগে থেকেই শুরু হয় বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহের সংগ্রাম। বিশেষ করে নারীরাই দলে দলে বের হন। তবে হাতে-মাথায়, সাইকেল-রিকশা-ভ্যানসহ ছোট ছোট গ্রামীণ যানবাহনের ওপরে-নিচে হরেক ধরনের পানির পাত্রসহ নানা বয়সী মানুষকেও ছুটতে দেখা গেছে। সর্বনিম্ন আধা কিলোমিটার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আড়াই-তিন কিলোমিটার দূরেও তাদেরকে পানি আনতে যাওয়া-আসা করতে হয়- জানালেন এসব হতদরিদ্র-অসহায় মানুষেরা। বাঁধের ভেতরে-বাইরের এসব গ্রাম-জনপদসহ পাথরঘাটার মানুষের জীবন-জীবিকা মাছ বিশেষ করে ইলিশ মাছনির্ভর। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ডাকাত-জলদস্যু, জলজ-বনের হিংস্র প্রাণীর হামলা আর ডুবে মরার ভয়-আতঙ্ককে পায়ে দলে নিয়ত ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বঙ্গোপসাগর, বিষখালী-বলেশ্বর নদী বা বেশ কয়েকটি খালের পানিতে নামতেই হয় তাদের। কঠোর পরিশ্রমী-সংগ্রামী মানুষগুলো পানির সঙ্গে যুদ্ধ করেই বেঁচে থাকে। বিপরীতে আবার পানির (বিশুদ্ধ) আকালেই রোগে-শোকে ভুগে ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকে।
সিডরে লবণ পানি এবং নানা ধরনের ময়লা-আবর্জনা ঢুকে অধিকাংশ পুকুরই দূষিত হয়। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পিএসএফ (পন্ডস অ্যান্ডস ফিল্টার) স্থাপন করে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে বেশিরভাগ পুকুরে। মানুষকে তাই পিএসএফযুক্ত পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করতে দূর-দূরান্তে যেতেই হয়। আর সাধারণ পুকুরের পানি কেউ আনলেও ফুটিয়ে বা ফিটিকিরি দিয়ে বিশুদ্ধ করে নেন।
শুষ্ক মৌসুমে পুকুর শুকিয়ে গেলে এ পানিও জোটে না। ফলে লবণাক্ত-দূষিত পানির সঙ্গে নিত্য তাদের বসবাস। পানির দেশে থেকেও পানি হয় মৃত্যুর কারণ।
পাথরঘাটা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও জেলেসহ উপকূলের মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা সংকল্প ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক মির্জা শহিদুল ইসলাম খালেদ বাংলানিউজকে জানান, ১৯১০ সালের দিকে পাথরঘাটার উৎপত্তির পর থেকেই লবণাক্ত-দুষিত-দুর্গন্ধময় পানি এখানকার মূল এবং স্থায়ী সমস্যা্। উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে চারটিতেই মাটিতে পাথরের আধিক্যে গভীর নলকূপ স্থাপন করা সম্ভব নয়। ফলে বিশুদ্ধ পানীয় জল সেগুলোতে একেবারেই দুষ্প্রাপ্য। বাকি তিন ইউনিয়নে নলকূপের পানিও লবণাক্ত। এসব কারণে পৌর এলাকার সাপ্লাইয়ের পানিও সরবরাহ করতে হয় ১৩/১৪ কিলোমিটার দূর থেকে এনে।
বিভিন্ন গ্রামের গৃহিণী রহিমা (৩৫), বয়োজ্যেষ্ঠ ইসমাইল হাওলাদার (৬৬), জেলে রিপন-জালাল দুই ভাই, মাছধরা নৌকার মাঝি (সরদার) দেলোয়ার (৪০), জাল বাওয়া (বাগি) কালছার (১২), ট্রলার ও মাছ ব্যবসায়ী আব্বাস (২৫), রহমান খাঁ (২৭), রহিম মুন্সী (৩৩) এবং জাহাঙ্গীরসহ (২৮) সবারই একই ভাষ্য-‘পানির লগে যুদ্ধ করি, পানিকে ভয় নাই। তয় খাইতে গেলেই পাই পচা আর নুন (লবণ)। ছাফ (পরিষ্কার) পানি দিতে অইবো সরকাররে’।
বাংলাদেশ সময়: ০০৪৫ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১৬
এএসআর/