ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূলে

দুর্যোগে গাছই ভরসা ‘হাভাইত্যার চর’বাসীর

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১৬
দুর্যোগে গাছই ভরসা ‘হাভাইত্যার চর’বাসীর ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

উপকূল থেকে ফিরে: ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস শব্দগুলো যেনো নিয়তিরই অরেক নাম উপকূলবাসীর কাছে। এইসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করেই বেচেঁ থাকা তাদের।

সাগরের বুকে জেগে ওঠা দ্বীপগুলোতে যুগের পর যুগ সুবিধাবঞ্চিত এই জনগোষ্ঠী বেঁচে আছে কেবল লড়াই করেই। এ যেনো ঠিক পোকা-মাকড়ের ঘরবসতিরই গল্প, বিশেষত বর্ষাকালে। তাই চরবাসীর ভাষায়- ‘ঢেপার দিনে (বর্ষাকালে) চরে থাকা আর স্বামী থাকতে ভিক্ষা করা একই কথা’।

দেশের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার, মানবাধিকার অর্থবহ হয়ে ওঠেনি এখানে।

পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার সদর ইউনিয়নের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাভাইত্যার চর। এ চরের মানুষের এখনো বেঁচে থাকার উপায় কেবল যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা। এরই একটা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের দিনে জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া, আর পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছ আঁকড়ে ভেসে থাকা। কোনো আশ্রয় কেন্দ্র নেই বলে এই প্রাকৃতিক নিয়মেই ভরসা চরবাসীর। শিক্ষা, চিকিৎসা বা নিরাপদ বাসস্থান এখানে কেবলই কল্পনায় আঁকা স্বপ্ন। স্বাধীনতার এতো বছর পেরিয়ে গেলেও এই চরের বাসিন্দারা জানে না মানবাধিকার কি, বা সংবিধান তাদের কি অধিকার দিয়েছে। তারা জানে কেবল বেঁচে থাকতে হয় নিজের চেষ্টায়।

হাভাইত্যার চরে বসবাসকারীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়! প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার বাস করে এখানে। সরকারি নথিতে অবশ্য এ চরের নাম ‘চর কাশিম’। ১৯৭০’র ঘূর্ণিঝড়ে এখানে বসবাসকারীদের সবাই ভেসে যায় জলোচ্ছ্বাসে। এরপরও থেমে থাকেনি জীবনের যাত্রা। নদী ভাঙনের শিকার বিভিন্ন জনপদের মানুষের সঙ্গে রাঙ্গাবালীর মূল ভূ-খণ্ডের বাসিন্দারাও এখনে এসে বসতি গাড়েন। এ চরের মোট জনসংখ্যা এখন প্রায় দেড় হাজার। বসবাসকারীদের সবাই ভূমীহীন। প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটারের এ চরের অর্ধেকের বেশিই বন বিভাগের সৃষ্টি ম্যানগ্রোভ বন। বাকি প্রায় পুরোটা প্রভাবশালীদের দখলে থাকা মাছের ঘের। এরই ফাঁক ফোঁকরে ‘পোকা-মাকড়ের ঘর বসতি’র মতো ঘর গৃহস্থলি ভূমিহীন চরবাসীর।

স্কুল না থাকায় এখানকার শিশুদের নেই লেখা-পড়ার সুযোগ। শিশুরা তাই বেড়ে ওঠে পড়া লেখার কথা না ভেবেই।

হাভাইত্যার চরের অধিবাসীদের প্রায় সবাই জেলে ও ভূমিহীন কৃষক। স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও এখানে গড়ে ওঠেনি কোনো ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র। খাবার পানির উৎস কেবলমাত্র দুইটা টিউবওয়েল।

রাস্তা না থাকায় চরবাসীর চলাচলের একমাত্র উপায় জমির আইল। কেনাকাটা থেকে শুরু করে প্রায় সব কাজে রাঙ্গাবালীর মূল ভূ-খণ্ডে আসতে চরবাসীকে রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে পার হতে হয় ভয়ংকর ‘বুড়ো গৌরাঙ্গ’ নদী।

রাঙ্গাবালী শহর থেকে যখন হাভাইত্যার চরের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন ঘুর্ণিঝড় পূর্বাভাস কেন্দ্র থেকে তিন নম্বর সতর্ক সংকেত ঘোষণা করা হয়েছে। স্থানীয় ‘গাঙনি পাড়া’ বাজার পর্যন্ত মোটরসাইকেলে এসে হাঁটু সমান কাদা ভেঙে মাইল দুয়েক পেরুলেই খেয়া ঘাট। শেষ বিকেলের টানা বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়ায় বুড়ো গৌরাঙ্গর তখন উত্তাল। নিয়তির হাতে নিজেদের সঁপে মানুষ সমান ঢেউ ভেঙ্গে প্রতিকূল আবহাওয়াতেই চরবাসী পার হচ্ছেন ‘বৈঠা টানা’ নৌকায়! নৌকোর মাঝির বয়স মাত্র ১৩। নাম শাকিল। সেও হাভাইত্যার চরের বাসিন্দা। ক্ষেপে ওঠা নদী পেরুতে দাঁড় টানছেন সহযাত্রী এক বৃদ্ধ। হাল ধরে স্রোতের বুকে ‘ঘাই’ মারা শাকিল আচমকাই বলে ওঠে, ‘পানির আইজ মাথা গরম’।

নদী পার হয়ে কিছুদূর যেতেই মেলে বসতির চিহ্ন। টিপটিপ বৃষ্টির হিমেল গোধূঁলী বেলায় একটি চায়ের দোকানে জড়ো হয়েছেন বেশ ক’জন। এদেরই একজন ষাটোর্ধ লাল মিয়া হাওলাদার। তিনি জানালেন, সিডর, রোয়ানুতে এখানকার খবর কেউই রাখেনি। নিজেদের মতো করে এইসব দুর্যোগ তারা পার করেছেন জঙ্গলে গিয়ে গাছ ধরে। বউ-বাচ্চা সবাই একই পদ্ধতিতে দিন পার করছেন তারা।

হাভাইত্যার চরের জীবন সম্পর্কে লাল মিয়া বলেন, “এইহানে কোনো ইস্কুল নাই। যারা পোলাপান পড়াইতে চায়, তারা পোলাপান ওপারে আত্মীয় বাড়ি রাইহে আয়। যারা এইহানে থাহে তাগো পোলাপাইন ১০/১২ বছর হইলে হাতার (সাতাঁর) শেহার (শেখার) পর স্কুলে যাওয়া শুরু হরে। কিন্তু বর্ষার সময় স্কুলে যাওয়া বন্ধ থাহে। চিকিৎসা বলতে ঝাড়ফুঁকই ভরসা”।

হাভাইত্যার চরের বাসিন্দাদের দুর্যোগ মোকাবেলার অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে বলেন, “অভিজ্ঞতা আর কি! গতকাইলই রাইতে ভাবছিলাম আইজও বুঝি গাছে উঠতে ওইবে। পরে রাইতের জোয়ার শ্যাষে ভাটা লাগার পর শেষ রাইতে ঘুমাইতে গেছি”।

এতো কিছুর পরও এই চরে থাকার কারণ কি- জানতে চেয়েছিলাম চরবাসী মকবুল হোসেনের কাছে। তিনি বলেন, “আমার বাপ এইহানে আইছেলে। আমারও জন্ম এইহানে। মাটির ওপর মায়া জন্ম হইয়ে গেছে। এইজইন্যই পইড়া আছি। যাতে মরলে এইহানেই মরতে পারি”।

মকবুল হোসেন আরও জানান, সিডর আর রোয়ানুতে হাভাইত্যার চরের মানু (মানুষ) সবাই বাগানে যাইয়া গাছ ধইরা ভাইসা ছেলে (ছিলো)। তয় কোনো ক্ষতি হোয় (হয়) নাই। পানি নামার পর সবাই নিরাপদেই বাড়ি ফিরতে পারছেলে (পেরেছিলো)”।

রাঙ্গাবালী উপজেলার প্রকল্প উন্নয়ন কর্মকর্তা তপন কুমার দাস বলেন, এই চরের মানুষ খুবই অসহায়। এখনও মানবেতর জীবন যাপন করে। আধুনিক রাষ্ট্রের মানবাধিকার কি, বা সংবিধান তাদের কোন কোন অধিকার নিশ্চিত করেছে- তারা জানে না। এখানে কোনো স্কুল না থাকায় শত শত শিশু শিক্ষাজীবন ছাড়াই বেড়ে ওঠে। স্কুল না থাকায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রও হয়নি।

এ বিষয়ে কথা বলছিলাম পটুয়াখালীর জেলার সন্তান ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল মালেকের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি এই চরাঞ্চলেরই মানুষ। এখানকার মানুষের কান্নার রোল কারো কানে গিয়ে পৌঁছায় না। ৫ বছর আগে রাঙ্গাবালিকে উপজেলা হিসেবে ঘোষনা করেছে সরকার। এই ৫ বছরে ৫ জন উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তার সেখানে নিয়োগ হয়েছে। কিন্তু দুর্গম বলে কেউই কাজে যোগ দেননি। সেখানে ৫টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। ৫জন এমবিবিএস ডাক্তারের পোস্ট আছে। নিয়োগও আছে। কেউ কাজে জয়েন করেছে বলে শুনিনি। ৪৬ জন উপজেলা কর্মকর্তার থাকার কথা। কিন্তু আছেন তিনজন। এই যখন অবস্থা, তখন সেখানকার মানুষের আশা আকাঙ্খার কথা সরকারের কানে পৌছুবে কার মাধ্যমে!

তিনি বলেন, একজন মানুষ ঘুর্ণিঝড়ে আশ্রয় নেয় জঙ্গলে। আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায়, সে বন্য প্রাণীর সঙ্গে রাতে ঝড় জলোচ্ছাসে গাছ ধরে ভেসে থাকে। একটু ঝিমুনি আসলে বা হাত ছুটে গেলে সে ভেসে যাবে পানির টানে। এরচেয়ে ভয়ংকর আর কি হতে পারে!

বাংলাদেশ সময়: ০৭০৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১৬
আরএম/এটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।