উড়ির চর (চট্টগ্রাম) থেকে ফিরে: সাগর-নদীর অবারিত জলরাশি বেষ্টিত ছোট জনপদ ‘উড়ির চর’। জোয়ার-ভাটায় তাল মিলিয়ে চলে এখানকার জীবন।
সুদিন ফিরলেও সংকট এখনও অনেক। চারদিকেই পানি হওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, দুই জেলার মধ্যে সীমানা বিরোধ ও নদী ভাঙনের মতো সমস্যা টেনে ধরেছে চরের অগ্রগতি।
ধান, সবজি, মাছ ও কাঁকড়ায় সমৃদ্ধ এই চরের বর্তমান চিত্র দেখে এসে লিখেছেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সোলায়মান হাজারী ডালিম।
৬ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্বে থাকছে নদী ভাঙনের কথা।
![](http://bnpub.banglanews24.com/public/userfiles/images/29-09-2022-Aysha/2-10-2022-AAT/3-10-2022-AAT/5-10-2022-AYT/5-10-2022-AAT-2/5-10-2022-3-AAT/05-10-2022-4-aat/13-10-2022-AAT/19-10-2022-AAT/20-10-2022-aat/24-10-2022-AAT/25-10-2022-AAT/udir-char-3.jpg)
উড়ির চরের দক্ষিণ প্রান্তে কালোনি বাজারের পাশে ট্রলার ঘাটের চা দোকানি আনোয়ার হোসেন।
ওই এলাকায় ৯ বছর ধরে ব্যবসা করে আসছেন তিনি। নদী ভাঙনের ভয়াল অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি জানান, নয় বছরে ভাঙনের শিকার হয়েছেন ৬৫ বার। ভাঙনের কারণে দোকান সরিয়ে নিতে হয় প্রতি দেড় থেকে দুই মাস পরপর।
আনোয়ার বলেন, বয়স হয়েছে তেমন কিছুই করতে পারি না, দোকানটাই ভরসা, তাই বার বার ভাঙলেও আবার তৈরি করি।
চরের এ অংশে ভাঙনের শিকার শুধু আনোয়ার নয়, আরও হাজারো মানুষের ঘর, জমি, পুকুর, মসজিদ এবং বাজার গিলে খেয়েছে মেঘনা। দীর্ঘদিন ধরে পলি জমে গড়ে উঠা উড়ির চর এভাবেই যাচ্ছে নদীর বুকে। মানুষের ক্রমাগত শ্রমে-ঘামে তৈরি হওয়া জনপদ বিলীন হচ্ছে।
বয়সে তরুণ, চরের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, বেশি দিন আগের কথা নয়, ওই যে যেখানটায় নদীর পানি দেখছেন সেখানেই ছিল আনছু মুন্সিবাজার, ছিল বিশ্ব মসজিদসহ আরও কত কী। এখন সেখানে শুধুই পানি। এক সময়ের ব্যস্ত এলাকার কোন চিহ্নই নেই।
![](http://bnpub.banglanews24.com/public/userfiles/images/29-09-2022-Aysha/2-10-2022-AAT/3-10-2022-AAT/5-10-2022-AYT/5-10-2022-AAT-2/5-10-2022-3-AAT/05-10-2022-4-aat/13-10-2022-AAT/19-10-2022-AAT/20-10-2022-aat/24-10-2022-AAT/25-10-2022-AAT/udir-char-river-7.jpg)
চরের জনতা বাজার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নুরউদ্দিন বলেন, যেভাবে ভাঙছে এটা অব্যাহত থাকলে আর বেশি দিন লাগবে না, অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই বিলীন হয়ে যাবে কলোনি বাজার, ইতোমধ্যেই ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ও পোস্ট অফিস ভবন বিলীন হয়ে গেছে।
তরুণ ওই ব্যবসায়ী বলেন, উড়ির চরের দক্ষিণ প্রান্তে প্রায় ৭ থেকে ৮ কিলোমিটারজুড়ে নদী ভাঙছে। এখনই কার্যকরী ব্যবস্থা না নিলে কলোনি এলাকায় বসবাসকারী ১৫০ পরিবারের ৬ শতাধিক মানুষ ঘর হারা হতে দেরি হবে না।
নদীর বুকে বিলীন হওয়া সন্দ্বীপের ন্যায়মস্তি এলাকার বাসিন্দা কবির আহম্মদ বলেন, ন্যায়মস্তি দরিয়ার চলে যাওয়ার পর খবর পাই এখানে চর উঠছে, সব হারিয়ে এখানে নতুন করে বসতি গড়ে তুলেছিলাম। এখন এ চরও ভাঙছে। গেল ৫ বছরে ৩০ বারের বেশি ভাঙনের শিকার হয়েছি।
চরের প্রবীণ এ বাসিন্দা বলেন, সরকার কোনো ব্যবস্থা না নিলে নদীতে ডুবে মরা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
উড়ির চর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ হাসানও জানালেন ভাঙনের কথা।
![](http://bnpub.banglanews24.com/public/userfiles/images/29-09-2022-Aysha/2-10-2022-AAT/3-10-2022-AAT/5-10-2022-AYT/5-10-2022-AAT-2/5-10-2022-3-AAT/05-10-2022-4-aat/13-10-2022-AAT/19-10-2022-AAT/20-10-2022-aat/24-10-2022-AAT/25-10-2022-AAT/udir-char-river-erosion-pic.jpg)
তিনি জানান, উড়ির চর ইউনিয়নের ৬ এবং ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পুরোটাই গেছে নদীতে, ৫ নম্বর ওয়ার্ডেরও বেশির ভাগ চলে গেছে। ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কিছু অংশ বাকি রয়েছে। চর ক্রমাগত ভাঙছেই।
উড়ির চর ছাত্র ফোরামের সাবেক সভাপতি সোহেল রানা বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত নদীর সঙ্গে বহু সংগ্রাম করে ঠিক থাকতে হচ্ছে। বিগত দিনে নদী ভাঙন নিয়ে আমরা বিশাল মানববন্ধন করেছিলাম। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হওয়ার পর পানি সম্পদ মন্ত্রী কর্নেল জাহিদ ফারুক (এমপি) পরিদর্শন করেছিলেন। কাজের কাজ এখনো আমরা কিছু দেখতে ফেলাম না। এভাবে চলছে আমাদের জন-জীবন। উড়িরচর রক্ষায় ২০১৫ সালে সরকারের পক্ষ থেকে একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও সেটি রহস্যজনক কারণে বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
![](http://bnpub.banglanews24.com/public/userfiles/images/29-09-2022-Aysha/2-10-2022-AAT/3-10-2022-AAT/5-10-2022-AYT/5-10-2022-AAT-2/5-10-2022-3-AAT/05-10-2022-4-aat/13-10-2022-AAT/19-10-2022-AAT/20-10-2022-aat/24-10-2022-AAT/25-10-2022-AAT/udir-char-river-04.jpg)
উড়ির চরের দক্ষিণ-পূর্বে সন্দ্বীপ চ্যানেল ও সন্তোষপুর ইউনিয়ন। পূর্বে সন্দ্বীপ চ্যানেল ও মীরসরাই উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়ন। উত্তরে সন্দ্বীপ চ্যানেল ও নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়ন। পশ্চিমে নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চর এলাহী ইউনিয়ন, সন্দ্বীপ চ্যানেল ও সুবর্ণচর উপজেলার চর ক্লার্ক ইউনিয়ন এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
১৯৭০-৭১ সালে সন্দ্বীপের উত্তর-দক্ষিণ ও মেঘনার মোহনায় চরটি জেগে ওঠে। ৮০’র দশক থেকে নদী সিকিস্তি ভূমিহীন মানুষ এখানে এসে বসতি গড়েতে থাকে। এরপর ক্রমাগত বাড়তে থাকে জন বসতি। প্রায় ৫০ বছরে তৈরি হওয়া এ জনপদকে রক্ষা করতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ দাবি স্থানীয়দের।
জনতা বাজার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নুরউদ্দিন বলেন, এ দ্বীপ থেকে জেলা সদর চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী কিংবা অন্যান্য স্থানে যখন ইচ্ছা তখন যাওয়া যায় না। নৌপথই একমাত্র উপায়। নৌপথে চলাচল করতে যেমন হয়রানির শিকার হতে হয়, তেমনি পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ। এই দুরাবস্থা থেকে উড়িরচরকে রক্ষা করতেই নোয়াখালী-উড়িরচর ক্রসড্যাম নির্মাণের দাবি ওঠে।
এ ড্যাম নির্মাণ করা হলে সম্ভাবনাময় এ দ্বীপ শুধু ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে না, বিপুল পরিমাণ ভূমিও উদ্ধার হবে। ভাঙন রোধ আর বিপুল পরিমাণ ভূমি উদ্ধারের লক্ষ্য সামনে রেখে প্রস্তাবিত ক্রসড্যাম নির্মাণের কাজ গত চার দশকেও শুরু হয়নি। কবে নাগাদ এ কাজ শুরু হবে কিংবা তা আদৌ হবে কিনা, এ নিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। চরের চার পাশে যদি মুছাপুরের মত ব্লক দিয়ে বাঁধ দেওয়া যায় তাহলে চর রক্ষা পাবে।
উত্তর সন্দ্বীপ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ও সন্দ্বীপের প্রবীণ সাংবাদিক মিজানুর রহমান বলেন, ২০১৫ সালের দিকে উড়ির চর থেকে সুবর্ণচর পর্যন্ত একটি ক্রসডেম হওয়ার কথা ছিল। চরের অন্য অংশে ভাঙনের সম্ভাবনা থাকায় এটি তখন আর হয়নি। এখন শুনছি সরকার ১২৪ কোটি টাকা ব্যয় একটি প্রকল্প গ্রহণ করছে।
যা নোয়াখালীর সুবর্ণচর ও উড়ির চরের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ করবে। প্রবীণ এই সাংবাদিক আরও বলেন, সুবর্ণচরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ তৈরির চেয়ে চরের চার পাশে ব্লক দিয়ে বেড়িবাঁধ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে চরটা রক্ষা পাবে এটা না করতে পারলে ভাঙন থামানো যাবে না।
অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান আরও বলেন, উড়ির চরের এই ভূমির মালিক সন্দ্বীপের মানুষ। অথচ এখন শোনা যাচ্ছে উড়ির চরের বড় অংশ নাকি নোয়াখালীর সঙ্গে যুক্ত করা হবে।
তিনি বলেন, সন্দ্বীপের বিভিন্ন এলাকা ভেঙে ভাসানচর, সন্দ্বীপ তৈরি হয়েছে। সেগুলোও সন্দ্বীপের সঙ্গে যুক্ত না করে নেয়াখালীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। সন্দ্বীপের নেতৃত্ব সংকটের কারণে এমনটা হচ্ছে।
এ বিষয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড ডিভিশন-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদুজ্জামান খান বলেন, উড়ির চরের বিষয়ে ২০১৪-১৫ সালে একটি সমীক্ষা চালানো হয়, এতে তিনটি ক্রসডেমের বিষয়ে উঠে আসে। সেই প্রকল্পের কী অবস্থা তা তিনি জানাতে পারেননি। পানি উন্নয়ন বোর্ড নোয়াখালীর সাথে যোগযোগ করতে বলেন।
কথা হয় নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সী আমির ফয়সালের সঙ্গে।
তিনি জানান, উড়ির চর থেকে নোয়াখালীর চর ক্লার্ক পর্যন্ত ৫ দশমিক ৫৫ কিলোমিটার ক্রসডেম পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাবিত রয়েছে। এটির সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৩৫ কোটি টাকা। ক্রসড্যাম বাস্তবায়ন হলে এ জনপদের নদী ভাঙনরোধ করা সম্ভব হবে।
উড়িরচর ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবদুর রহিম বলেন, উড়ির চর প্রতিনিয়ত ভাঙছে, এ ভাঙন থেকে রক্ষা করতে হলে চরের চার পাশে বেড়িবাঁধ দিতে হবে। আমরা সরকারের ওপর মহলে জানিয়েছি। সরকার পদক্ষেপ নিলে এ চর ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে।
এ চরের সমিতি বাজার, বাংলা বাজার, কলোনি বাজারসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বললেও এমন দাবিই উঠে আসে। তারা চরের চার পাশে টেকশই বেড়িবাঁধ চায়, ব্লক দিয়ে যদি বেড়িবাঁধ দেওয়া যায় তাহলে টিকবে তাদের ভিটে-মাটি। তা নাহলে অচিরেই বিলীন হবে নদীর বুকে। (চলবে)
আরও পড়ুন>>তবুও জীবন থেমে নেই!
বাংলাদেশ সময়: ১১১৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০২২
এসএইচডি/এএটি