ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কর্পোরেট কর্নার

সৌদিদের রমজান-সংস্কৃতির অপূর্ব চিত্র

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৩ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০১৯
সৌদিদের রমজান-সংস্কৃতির অপূর্ব চিত্র পথে পথে বিতরণ করা হয় ইফতার সামগ্রী। ছবি: সংগৃহীত

রমজানের আবহ শুরু হওয়ার আগে থেকেই সৌদি আরবের মানুষ মহিমান্বিত মাসকে বরণ করে নিতে আগাম প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। বড়দের পাশাপাশি ছোটদের মনেও আনন্দ-উচ্ছ্বাসের দোলা লাগে। শারীরিক ও মানসিক-নানাভাবে তারা নিজেদের প্রস্তুত করে। রমজানের চাঁদ উদিত হবার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে হতে তাদের মাঝে রমজানের প্রস্ততি দেখা যায়।

ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য কেনাকাটায় তাদের আগ্রহ ও উদ্দীপনার কোন কমতি থাকে না। প্রত্যেকে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী নিজেদের কেনাকাটার কাজ সেরে নেয়।

নারীরা নতুন মাস বরণের অংশ হিসেবে নতুন নতুন পাত্র ও আসবাবপত্র ক্রয় করেন। নানা ধরনের রঙিন বাতি ও রং দিয়ে রাস্তাঘাট সাজানো হয়। উঁচু দালান-কোঠা, শপিংমল এবং রাস্তার মাঝের ও দুই পাশের সড়কবাতির খুঁটিগুলোতে ছোট ছোট লাইট লাগানো হয়। সড়ক-মহাসড়কগুলো এক ভিন্ন বৈচিত্রের রূপাবয়ব ধারণ করে।

রমজান উপলক্ষে রাস্তা-ঘাট সাজানো হয় অপূর্ব সাজে।  ছবি: সংগৃহীত

‘শাবানিয়া’ অনুষ্ঠান পালন
রমজানের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সৌদিরা এর নাম দিয়ে থাকে ‘শাবানিয়্যা’ বা ‘শাবানা’। এতে তাদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশীর লোকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। স্বতঃস্পূর্তভাবে সবাই এতে অংশ নেয়। এতে দেশীয় নানা জাতের খাবার ও মিষ্টান্ন পরিবেশন করা হয়।

সড়কদ্বীপগুলোও সাজানো হয় অপূর্ব সাজে।  ছবি: সংগৃহীত

পুরো সৌদি আরব জুড়ে রমজানে বিশেষ এক আধ্যাত্মিক পরিবেশ বিরাজ করে। তার কারণ, মক্কা-মদীনার মতো ঐতিহাসিক দুটি পবিত্র ভূখণ্ড এ দেশে অবস্থিত। সৌদিরা রমজানের আগমনের সুনিশ্চিত বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যমে অবগত হয়। রমজানের চাঁদ দেখা নিশ্চিত হবার পর সবার হৃদয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ফোনে কিংবা ক্ষুদেবার্তা প্রেরণ করে একে অপরকে সম্ভাষণ জানায়। ‘রমজানের অভিনন্দন’, ‘সদা তোমরা ভালো থেকো,’ ‘খোশ আমদেদ মাহে রমজান’ এবং ‘আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, যেন তিনি আমাদের ও তোমাকে তার সিয়াম ও কিয়াম পালনের তৌফিক দিন’ ইত্যাদি বাক্যমালায় সাজানো থাকে তাদের বার্তাগুলো।

সাধারণ মানুষদের সঙ্গে বসে ইফতার করেন অসাধারণরাও।  ছবি: সংগৃহীত

দৈনন্দিন কর্মসূচি
আরবদের সাধারণ অভ্যাস হলো, আজানের সঙ্গে সঙ্গে তারা শুকনো ও পাকা খেজুর এবং পানি দ্বারা ইফতার করে। তারপর মুআজ্জিন নামাজের ইকামত দিলে খাবার ছেড়ে সবাই জামাতের জন্য ছুটে। মাগরিবের নামাজ আদায়ের পর সবাই মিলে ইফতারের মূলপর্ব শুরু হয়। যার সর্বাগ্যে থাকে দেশীয় ঘি দিয়ে তৈরি এক ধরনের ‘ফুল’ ও জাইতুনের তেল। ফুল ছাড়া যেসব খাবার দ্বারা তাদের টেবিল ও দস্তরখানা ভর্তি থাকে,তা হলো গোস্ত বা সবজি দিয়ে তৈরি সমুচা, এক ধরণের সুরবা ও তমিজের রুটিসহ দেশীয় প্রচলিত নানা ধরনের খাবার।

পথের দ্বারে ইফতারের আয়োজন।  ছবি: সংগৃহীত

সুরবা (স্যুপ) আরবদের মূল খাবারের অংশ। শরীরে চাঙ্গা ও ফুরফুরে ভাব ফিরিয়ে আনতে এশা ও তারাবিরি আগে  লাল চা ও গাহওয়া পরিবেশন করা হয়। বিশেষ করে ঘরে মেহমান থাকলে তাদের মাঝে ঘরের একজন সদস্য রুটির পাত্র নিয়ে হাজির হন। তারপর ইফতারপর্ব শেষ করে সবাই এশা ও তারাবিহর জন্য মসজিদমুখী হন।

নামাজের পর অধিকাংশ মসজিদে দ্বীনি কিছু আলোচনা হয়। যা মসজিদের ইমাম পেশ করে থাকেন বা কোন আলেমকে দাওয়াত করে আনা হয়। মানুষেরা প্রত্যেক রাতে কোন বাসায় একসাথে একত্রিত হয়ে কিছু সময়ের জন্য নৈশালাপে মেতে ওঠে। তারপর কেউ কেউ ঘুমাতে চলে যায়। আর এই সংখ্যাটা নিতান্তই কম। অধিকাংশরাই পুরো রাতকে ইবাদত কিংবা প্রয়োজনীয় কেনাকাটা বা ব্যক্তিগত অন্য কোন কাজের পেছনে ব্যয় করে।

তারাবির পর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে যান সৌদিরা।  ছবি: সংগৃহীত

দিনের বেলা দোকান-পাট ও বিপনী বিতানগুলো বন্ধ থাকে। দিনের নীরবতা রাতে সরবে পরিণত হয়। তারপর সাহরি খাওয়ার জন্য সবাই একত্রিত হয়। দেশীয় রুটি, আরবি ঘি,’ দই, ভাত ও মুরগীসহ যাবতীয় দেশীয় খাবারে ভোর রাতের খাবারটি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে। রমজানের শুরুতে ওমরার হিড়িক পড়লেও শেষের দিকে সবাই ওমরার জন্য ছুটে। আর শেষ দশ দিনের আগমণে কেউ কেউ ইতিকাফের জন্য মক্কা কিংবা মদীনায় অবস্থান করে।

শ্রমিকদের জন্য আয়োজিত ইফতার-দস্তারখান।  ছবি: সংগৃহীত

আত্মীয়-স্বজনের সাথে সাক্ষাৎ
সৌদিআরবের গুরুত্বপূর্ণ রীতিনীতির একটি হলো, এশা ও তারাবিহ শেষে পরিবারগুলো নিজেদের আত্মীয় ও প্রতিবেশীর সাথে পরস্পরে সাক্ষাতে মিলিত হয়। তাছাড়াও কিছু কিছু পরিবারে রীতিনীতি অন্যদের হতে ভিন্ন। পরিবারের একজন সদস্য ইফতারের যাবতীয় কিছু ব্যবস্থা করবে। এভাবে পালাক্রমে চলতে থাকবে। আর এটি শুরু হবে পরিবারের বয়সে বড়কে দিয়ে।

পথে পথে সাধারণ মানুষদের জন্য বিভিন্ন ইফতার সামগ্রী সাজিয়ে রাখা হয়।  ছবি: সংগৃহীত

কল্যাণমূলক কিছু কাজ
সৌদিআরবে কিছু রীতিনীতি চোখে পড়ার মতো। সেটি হলো, এখানকার মুসলিম জাতিগোষ্ঠী ও প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য ফ্রি ইফতারির আয়োজন করা। এসব আয়োজন সাধারণত মসজিদের নিকটে অথবা ঐসব শিল্পাঞ্চলে করা হয়, যেখানে শ্রমিকরা অধিক পরিমাণে অবস্থান করেন। বিভিন্ন প্রকারের পানীয়, দই, জুস, ফল, কেক ও খেজুর ইত্যাদি দিয়ে প্যাকেট তৈরি করে সামর্থবানরা মসজিদে কিংবা রাস্তাঘাটে ইফতার বিতরণ করেন।

আর আরেকটি মুগ্ধকর দিক হলো, মাগরিবের আজানের সময় রাস্তার বিভিন্ন সিগন্যালে ওই সব লোকের মাঝে ইফতারের প্যাকেট বিতরণ করা হয়, যারা তাদের আবাস থেকে দূরে আছে। এ হলো সৌদি আরবের সাধারণ অবস্থার মৌলিক চিত্র। তবে স্থান আঞ্চলিকতা ভেদে কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়, মক্কা মুকাররামা, সৌদি আরব

রমজানবিষয়ক যেকোনো লেখা আপনিও দিতে পারেন। লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০১৯
এমএমইউ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।