ঢাকা, বুধবার, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

হাথুরু জানালেন, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেটে আমার ক্যারেক্টারটাও আছে...’

মাহমুদুল হাসান বাপ্পি, স্টাফ করেসন্ডেন্ট (স্পোর্টস) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৩
হাথুরু জানালেন, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেটে আমার ক্যারেক্টারটাও আছে...’

চন্ডিকা হাথুরুসিংহে কি বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে চর্চিত নামগুলোর একটি? চাইলেই প্রশ্ন তোলা যায় এমন। সাড়ে তিন বছর হেড কোচের দায়িত্বে ছিলেন, পরেও তাকে নিয়ে থামেনি চর্চা।

কথায়, ক্রিকেটীয় আড্ডায় প্রায়ই ঘুরেফিরে এসেছেন এই লঙ্কান। এবার তো চলে এলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটেই।

বুধবার জাতীয় দলের অনুশীলন ছিল না। তবুও মিরপুরের মিডিয়া গেট খুলেছে ‘খুব সকালে’। প্রায় শূন্য মিরপুরে দুয়েকজন ক্রিকেটার অনুশীলন করছেন, তবে তাদের নিয়ে আগ্রহ দেখা যায়নি তেমন। কিউরেটর গামিনি ডি সিলভাই বরং বেশি আলোচনায়। তার স্বদেশি এসেছেন, এখন উইকেট কেমন করেন তা এক বড় প্রশ্ন।

সব ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় আলোচনা হাথুরুকে ঘিরে। বিমানবন্দরে দু-চার শব্দ বলেছেন বটে, কিন্তু তাতে তো কৌতূহলের শিকিভাগও পূরণ হয়নি। দুপুর আড়াইটায় সংবাদ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এসেছিল, কিন্তু বুম-ক্যামেরা-লাইটের উপস্থিতি বাড়া শুরু করলো সূর্য উঠার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।

অপেক্ষার পালা ফুরোয়, হাথুরুসিংহে আসেন সংবাদ সম্মেলনে। তাকে নিয়ে ‘না থামা চর্চা’ যে পৌঁছেছিল তার কাছে, জানান সেটি। প্রথমবার চাকরির প্রস্তাব পেয়েই কি ফিরে এলেন? হাথুরু বললেন, ‘নাহ...’। দ্বিতীয়বার? প্রশ্নের উত্তরও হলো একই। বোঝা গেল, হাথুরু অন্তত বার কয়েক প্রস্তাব পেয়েই ফিরেছেন বাংলাদেশে।

কেন? তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতি সবসময়ই আমার একটা সফট কর্নার আছে। আমার প্রথম আন্তর্জাতিক অ্যাসাইনমেন্ট ছিল এখানে। ’ কিন্তু এখনই কেন? ‘বিশ্বকাপ সামনে রেখে এটাকেই সঠিক সময় মনে হয়েছে’ বলেন এমন।

আগের দুদিন সাদা টি-শার্ট, থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট ও ক্যাপের হাথুরু আজ পুরোদস্তর ‘কোচের পোশাকে’ এসেছিলেন। শুরুর আগে অনেক ক্যামেরা তার মুখের কাছে ভিড়েছে, অনেক শাটারের ক্লিকের শব্দ পৌঁছেছে কানে। হাথুরু ছিলেন তবুও কক্ষপথে, মনোযোগী শ্রোতা ও সাবধানী উত্তরদাতা হিসেবে।

কোথাও বলেছেন, ‘একই প্রশ্ন আগেও করা হয়েছে...। ’ কখনো নরম স্বরেই বলে ফেলেছেন, ‘আপনার প্রশ্নটা ছিল রাবিশ...’। তাকে নিয়ে মিথের কমতি নেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে। কড়া হেডমাস্টার, একরোখা, সিনিয়রদের সঙ্গে মনোমালিন্যসহ আরও নানা কিছু।

হাথুরু কি আগের মতোই আছেন, নাকি বদলে গেছেন? জবাবে তিনি করেছেন রসিকতা, ‘বয়সটা কেবল একটু বেড়েছে...। ’ রসিকতা পর্ব অবশ্য ছিল পরেও। তবে বেশ সিরিয়াস ভঙ্গীর এক প্রশ্নে। মাশরাফি বিন মুর্তজা ক’দিন আগেও বলেছেন, ‘জাতীয় দলে খেলার আশা করি না...’

তবুও এলো তার প্রসঙ্গ, তাকে কি আবার ফেরানো হবে ওয়ানডেতে? প্রশ্নটা শুনেই হাথুরু বললেন, ‘নির্বাচনের জন্য? আমার মনে হয় ও এখন আর খেলে না...’ সিনিয়রদের আলাপকে হাথুরু দূরে সরিয়ে রেখেছেন এমন কিছু বলে, ‘আগেরবারও সিনিয়র খেলোয়াড়দের নিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জ ছিল না, এবারও নেই। ’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সংবাদ সম্মেলনে এলো বটে, তবে বড় অংশজুড়েই থাকলো অতীত। যাওয়ার সময় নাকি সাকিব আল হাসানের দল ও দেশের প্রতি ‘কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন’ তুলে গিয়েছিলেন চন্ডিকা। তিনি আগে ও এখন দেশের সবচেয়ে বড় তারকা তো অবশ্যই, টেস্ট ও টি-টোয়েন্টির অধিনায়কও। এমন একজনের সঙ্গে কাজ করা কতটা কঠিন হবে?

শুনে যেন বিস্মিতই হলেন, ‘এটা তো আমার জন্য নতুন খবর। ’ নাজমুল হাসান পাপন তার বরাত দিয়ে জানিয়েছিলেন এমন, বলা হয় হাথুরুকে। তিনি এরপর বলেন, ‘কখনো এমন কিছু শুনিনি। আমার কখনো এমন মনেও হয়নি...। ’

বাংলাদেশ ছেড়ে হাথুরু গিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কায়। তখন ‘নাগিন নৃত্য’ বা এমন কিছুতে সরব ছিল দু'দলের দ্বৈরথ। দুয়েকবার কথা কাটাকাটিও হয়েছে এদিক-ওদিক। বৈরিতা কি হয়েছিল কারো সঙ্গে? এমন কিছুকে উড়িয়ে ‘রাবিশ প্রশ্ন’ বলেছেন হাথুরু।

এরপর জানিয়েছেন আনন্দ ও গর্বের কথা। শিষ্যদের বুক চিতিয়ে লড়াই করতে শিখিয়েছিলেন, ‘প্যাশন’ নিয়ে খেলতেও। ভিন্ন রঙে, আলাদা ড্রেসিংরুমে বসে সেসব দেখা ‘গর্বের’ ছিল হাথুরুর জন্য, জানিয়েছেন এমন কথাও।  

‘বাংলাদেশের কোচ থাকার সময় একটা জিনিস খেলোয়াড়দের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি- যেকোনো প্রতিপক্ষের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারা ও প্যাশন নিয়ে খেলা। তারা যখন এটা দেখিয়েছে, আমি উপভোগ করেছি। অন্য ড্রেসিংরুমে থেকেও গর্ব বোধ করেছি। ’

ওয়ানডেতে বাংলাদেশ ‘ঐতিহ্যগতভাবে’ ভালো দল, হাথুরু জানেন ও মনে করান সেটি। করেন স্মৃতির রোমন্থনও। ৯০ কিংবা ৭০ এর দশকে এ দেশের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের গল্প শুনেছিলেন শ্রীলঙ্কাতে বসেই, হাথুরু বলেন এমন। তাহলে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে কীভাবে ভালো করবে বাংলাদেশ?

হাথুরু জবাব দেন তারও, ‘টেস্ট ক্রিকেটে ভালো করছে। এমনকি নিউজিল্যান্ডে তারা এক ম্যাচ জিতেছে। ঘরের মাঠেও টেস্টে ভালো করছে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অবশ্য খুঁজে বের করতে হবে কীভাবে খেলব। যারা ভালো খেলছে তাদের অনুসরণ না করে...। আমাদের নিজেদের শক্তির জায়গা দরকার, আমাদের নিজেদের শক্তি আছে। সেটা খুঁজে বের করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জটার দিকে তাকিয়ে আছি। ’

হাথুরুর ‘আমি আছি’ তত্ত্ব বোঝা গেল শেষে এসে। সাফল্যের মূল জায়গায় একটুও সরেননি, বুঝিয়েছেন তা। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল, বড় তিন দলকে ঘরের মাঠে সিরিজ হারানো; চন্ডিকা হাথুরুসিংহের প্রথম মেয়াদের সাফল্যের কথা এলেই চলে আসে এসব। তবে তার আমলে বাংলাদেশ সাফল্য পেয়েছিল সাদা পোশাকেও, অন্তত ঘরের মাঠে।

অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মতো দলকে তার অধীনেই টেস্ট হারায় বাংলাদেশ। যদিও তখন প্রশ্ন ছিল স্পিন উইকেট নিয়ে। এমন পিচে খেলে স্বল্পমেয়াদী সাফল্যের পেছনেই ছুটেছেন হাথুরু, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল এমন। এসব কথা তার দ্বিতীয় মেয়াদে হেড কোচ হয়ে ফিরে আসার পর থেকে আলোচনায় আবারও। এলো সংবাদ সম্মেলনেও।

প্রশ্নটা প্রথমে বুঝলেন না ঠিকঠাক। ‘হোম অ্যাডভান্টেজের’ কথা বলতেই স্বর বদলালো তার। উল্টো সাংবাদিকের কাছে জিজ্ঞাসা, ‘হোম অ্যাডভান্টেজ আসলে কী?’ তাকে কিছু একটা বলতেই ফের ফিরতি প্রশ্ন, ‘আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করছি হোম অ্যাডভান্টেজ কী?’

এরপর বলতে শুরু করলেন নিজেই, ‘যখন আমরা নিউজিল্যান্ড যাই, কি ধরনের উইকেট পাই? ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া কি করে তাদের ঘরের মাঠে? ভারত এখন ঘরের মাঠে কি করছে?’ হাথুরুকে শোনার পর ‘তা ঠিক আছে...’ বলতেই তিনি বললেন, ‘তাহলে আপনার প্রশ্নটা কী!’

তারা করছে, তাদের দেশের বাইরে গেলে ভালো করার ক্ষমতাও তো আছে। বাংলাদেশের? হাথুরুই বোধ হয় সবচেয়ে ভালো দিলেন উত্তরটা, ‘দেশের বাইরে গেলে আমাদের যা আছে তা দিয়ে ম্যানেজ করতে হবে। যদি মিসাইল না থাকে তাহলে আপনি কীভাবে লড়াই করবেন? আমাদের তো গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে, তাই না? ওদের আমাদের ঘরে আসতে দিন, আমরা ছোট ছোট অস্ত্র দিয়ে লড়বো। যদি আমাদের অস্ত্র না থাকে তাহলে তো আমরা কিছু করতে পারবো না। আমরা শুধু খেলোয়াড়দের গড়ে তুলতে পারি। ’

‘আপনি এটা বলতে পারেন না। দক্ষিণ আফ্রিকায় ওরা ভালো করেছে। নিউজিল্যান্ডে ওরা ভালো করেছে। আমরা একটু আগে আলোচনা করলাম পেস বোলারদের নিয়ে, যারা উঠে আসছে। এবাদতের কথা মনে আছে। আমার প্রথম নিউজিল্যান্ড সফরে সে ছিল ডেভলপম্যান্ট প্লেয়ার। শান্তও। এখন ওরাই ভালো করছে। সুতরাং এটা করতে সময় লাগে। সব দেশই তাই করে। আমাদের ঘরের মাঠের সুবিধা নিতে হবে। আমাদের নিজেদের শক্তি অনুযায়ী খেলতে হবে। ’

শুরুতে মনোযোগী শ্রোতা ও ভালো বক্তা হাথুরু শেষে এসে চটলেন কিছুটা। তবুও দম হারালেন না। নিজস্বতার ছাপ, কাজের ওপর আত্মবিশ্বাস অথবা একরোখা স্বভাব; অন্তত কথাবার্তায় বদলায়নি তেমন। প্রত্যাশার চাপে কি ভুগবেন? ‘কোচরা সবসময়ই চাপে থাকে। ভালো করলে বলে ঠিক আছে, খারাপ করলে প্রশ্ন তুলে। ’

হাথুরু মনে করান নিজের নির্মম বাস্তবতাকেও। আবেগ, উচ্ছ্বাস, প্রত্যাশার চাপের ভিড় জমা হয় সংবাদ সম্মেলনে। জমা হয় নানা প্রশ্নও। সবকিছুর সারাংশ বোধ হয় এই- হাথুরু জানিয়ে দেন ‘আমার ক্যারেক্টারও কিন্তু এখন বাংলাদেশের ক্রিকেটে আছে...’। ভালো নাকি খারাপভাবে? আপাতত উত্তর সময়ের কাছে।

বাংলাদেশ সময়: ২১২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৩
এমএইচবি/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।