চট্টগ্রাম থেকে: ডাবলিনের কলেজ পার্ক ধরে হাঁটলে আপনি সঙ্গী হবেন অদ্ভূত এক অনুভূতির। দু’পাশে সারি সারি গাছ, পিচঢালা রাস্তাটা চলে গেছে সোজা।
লরকান টাকার উইকেটরক্ষক। এর বাইরে তার পরিচয় ব্যাটার হিসেবে। আক্রমণাত্মক ধাঁচের ব্যাটিং করেন। এবার বাংলাদেশে খেলতে এসে পেয়েছেন আয়ারল্যান্ডের সহ-অধিনায়কত্বও। অথচ এতক্ষণ ধরে আপনি যা কিছু পড়লেন, টাকারের বেড়ে উঠার স্বপ্নের সঙ্গে মিল নেই প্রায় কিছুরই। কেন? কারণ ক্রিকেটটা তিনি খেলতে চেয়েছিলেন বটে, কিন্তু হতে চেয়েছিলেন কিংবদন্তি অজি ফাস্ট বোলার ব্রেট লির মতো।
বাবা জন টাকার ক্রিকেট খেলতেন। খেলাটার সঙ্গে সম্পর্ক আছে ভাইদেরও। তবুও টাকারের জীবনে ছিল অনেক কিছুর সংশয়। শুরুটাও তেমনই। বাবা পেমব্রোক ক্লাবের হয়ে খেলতেন। তাকে সেখানে নিয়ে গিয়েও স্বস্তি পাচ্ছিলেন না ঠিক। এখন অবশ্য টাকারের মনে হয়, ‘বাবা ঠিক জায়গাটাতেই নিয়ে গিয়েছিলেন। পরিবারের জন্যও ক্লাবটা বিশেষ। এখান থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছি এই আনন্দ আলাদা। ’
জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের প্যাভিলিয়নের পাশে বসে লরকান ফিরে যান তার শৈশবেও, ‘আমার প্রথম ক্লাব পেমব্রোকও ছিল রাস্তার পাশে। ওখানেই ক্রিকেটার হয়ে জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি। হৃদয়ে সবসময়ই বিশেষ জায়গা আছে ক্লাবটার জন্য। ’
লরকান এখন যেমন, এমন তিনি হতে চাননি অবশ্যই। ২০০৫ সালের অ্যাশেজ দেখে প্রেমে পড়েছিলেন ব্রেট লির। অস্ট্রেলিয়ার হারের পরও তার মনে গেঁথে গিয়েছিল লির পারফরম্যান্স। এরপর লরকান পুরো শৈশব ছুটেছেন গতির নেশায়। অ্যাকশন নাকি গতি, কেন লির প্রেমে পড়া? আইরিশ ক্রিকেটার হাসিমুখে জানালেন ভিন্ন কিছু, ‘তার চুল, আক্রমণাত্মক মনোভাব, স্টাইল, ব্যাটারকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলার তাড়না; মুগ্ধ হয়ে দেখতাম টিভিতে। পুরো ছোটবেলাজুড়েই তার মতো হতে চেয়েছি, এটা নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই। ’
কেন তাহলে বদলে যাওয়া? কারণটাও বলছিলেন তিনি, ‘ক্লাবের একটা দলে উইকেটরক্ষক পাওয়া যাচ্ছিলো না। কোচ আমাকে এসে বললো, তুমি করবে? হাতছাড়া করতে চাইনি। ’ এরপর টাকারের জীবনজুড়ে জড়িয়ে গেছে কাজটা। এখন ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে তার ভাবনা কি বদলেছে? ‘মনে হয় না পেস বোলার হলে এতটুকু অবধি আসতে পারতাম। কথায় আছে, যা হয় ভালোর জন্যই; আমার জন্য অনেকটা তেমন এটা। ’
পেসার হওয়ার আনন্দ নিশ্চয়ই আলাদা। উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে টাকার প্রতিনিয়তই দেখেন সেসব। তাদের ছুটে আসা, বল ছোঁড়া কিংবা গতির নেশা; মনে কি এখন একটু আফসোসও হয় পেসার না হওয়ার? প্রশ্নটা শুনেই বলতে শুরু করেন আইরিশ ক্রিকেটার, ‘আফসোস অন্তত একদম নেই। এখন দেখি আমাদের পেসাররা কীসের মধ্যে দিয়ে যায়! (হাসি)। এটা খুব কঠিন কাজ। আমাদের সামনেই তিনটা টেস্ট আছে, ওদের খুব কঠিন সময় আসছে। পেছন ফিরে তাকালে মনে হয়, ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম। ’
তাহলে পেস বোলিংয়ের চেয়ে উইকেটকিপিং সহজ? ‘তাও না আসলে। দুইটা আলাদা স্কিল, ভিন্ন চ্যালেঞ্জ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কিছুই সহজ আছে বলে আমার মনে হয় না। ’ হংকংয়ের বিপক্ষে ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলার শুরু টাকারের। তখন উইকেটকিপিং তার কাছে সিরিয়াস ছিল না ততটা। পরে ভাবনা বদলে ফেলেন। এখন টাকারের চাওয়া উইকেটের পেছনে দাঁড়ানো সেরাদের একজন হওয়া।
‘বেন ফোকস আমার খুব প্রিয়। একজন উইকেকিপারের যেমন হওয়া উচিত, ও ঠিক তেমনই। টেস্ট ক্রিকেটের একটা ভালো ব্যাপার আছে- আপনি বসে ব্যাটার বা বোলারকে দেখতে পারবেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে। আপনি আবার ফোকসের উইকেটকিপিংও দেখতে পারবেন লম্বা সময়’- টাকার হয়তো এমন কিছু বলে বোঝান কিপিংটা তার হৃদয়ে কতটা।
প্রিয় বন্ধু হেরি টেক্টর। দুজন একই সঙ্গে অনূর্ধ্ব-১৯ খেলেছেন। এখন খেলছেন জাতীয় দলে। দুজন মিলে আইরিশ ক্রিকেট বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন, লরকান জানান টেক্টরের রূপান্তরে নিজের মুগ্ধতার কথাও, ‘আমি অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ যে হেরি টেক্টরের সঙ্গে খেলেছি, এখন যে টেক্টর; পুরোপুরি আলাদা। ভালো বন্ধুর সঙ্গে খেলা দারুণ ব্যাপার। ’
এরপর লরকান বলেন আইরিশ ক্রিকেট ব্র্যান্ড খুঁজে বেড়ানোর তাড়নার কথাও, ‘নতুন কিছু একটা তৈরি করতে চাচ্ছি আমরা। এখন ক্রিকেটের ব্র্যান্ড নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। টেস্টে বাজবল নিয়েও কথা হচ্ছে। আমরা আলাদা কিছু তৈরি করতে চাচ্ছি। এখনও আমরা আস্তে আস্তে এগোচ্ছি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দেখিয়েছি কী করতে পারি। এবার ওয়ানডে বিশ্বকাপ আসছে, সেখানেও দেখাতে চাই। ’
ব্যাটার লরকান কেমন? প্রশ্নটা শুনে আইরিশ ক্রিকেটার ব্যাখ্যা করেন নিজেকে, ‘আমি এই বাস্তবতা মেনে নিয়েছি, টিকে থাকতে হলে আমাকে মারতে হবে। যখন ইতিবাচক থাকি, তখনই ভালো খেলি। বোলারকে মারতে হবে। ডিফেন্স করতে গেলে মনে হয় আরও বেশি সমস্যায় পড়ি। ’
টেস্ট খেলার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠেছেন প্রায় সব ক্রিকেটারের মতোই। কিন্তু খেলার ধরনটা তো লাল বলের সঙ্গে যায় না। টাকার অবশ্য মানছেন না তা, তিনি টানলেন উদাহরণও, ‘হ্যারি ব্রুককে দেখুন, বিশ্বের অন্যতম সেরা টি-টোয়েন্টি ব্যাটার থেকে এখন টেস্টের সেরাদের একজন। আমার মনে হয় আপনার নিজেকে সীমাবদ্ধ করার কোনো দরকার নেই। ’
ব্যাটিংয়ের ধরনের কারণেই তার প্রিয় মাহেন্দ্র সিং ধোনি। তিনি এখন খেলছেন না। তার ‘সিগনেচার হেলিকপ্টার শট’ কী কখনও চেষ্টা করেছেন? অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন টাকার। এরপর বলেন বাস্তবতা, ‘মনে হয় না আমি ওভাবে ব্যাট ঘুরাতে পারবো। ’
‘ওভাবে’ না পারলেও টাকার ব্যাটটা ভালোই চালাতে জানেন। একটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচে তার আছে ১৫৫ রানের ইনিংসও। সেটিকে মনে করাতেই বিনয়ী হন টাকার, ‘মাঠটা ছোট ছিল, স্কয়ারের বাউন্ডারিটাও। আমি আবার সুইপ একটু ভালো খেলি...। ’
জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামে গোধূলি নেমে আসে ধীরে ধীরে, তাড়া থাকে টাকারের হোটেলে ফেরারও। তিনি যাওয়ার আগে বলেন, ‘সময়টুকু দারুণ ছিল। ’ তারও আগে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, কী স্বপ্ন নিয়ে বাঁচেন? টাকার বলেন এরপর, ‘লর্ডসে টেস্ট খেলবো। আগেরবার বেঞ্চে বসে ছিলাম। এবার...। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০২৩
এমএইচবি/এমএইচএম