ঢাকা, শনিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১ রবিউস সানি ১৪৪৬

ক্রিকেট

টেস্ট ক্রিকেটে যেভাবে পরাশক্তি হয়ে উঠল ভারত

স্পোর্টস ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০২৪
টেস্ট ক্রিকেটে যেভাবে পরাশক্তি হয়ে উঠল ভারত

১৯৩২ সালে লর্ডসে প্রথম ম্যাচ খেলার ৯২ বছরেরও বেশি সময় পর এক ইতিহাস গড়েছে ভারত। গত মাসে চেন্নাইয়ে বাংলাদেশকে হারানোয় টেস্ট ক্রিকেটে এখন ভারতের জয়ের সংখ্যা এখন পরাজয়ের চেয়ে বেশি।

৫৮০ টেস্ট খেলে তারা ১৭৯ ম্যাচে জিতেছে ও হেরেছে ১৭৮ ম্যাচে। ভারতের অসাধারণ এই পালাবদল ও টেস্ট ক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি হয়ে ওঠার পথটি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিতে তুলে ধরেছেন বর্ষীয়ান ক্রিকেট লেখক সুরেশ মেনন।  
 
মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এমন মুহূর্ত আসে যখন পরিস্থিতি ও মানুষ এক বিন্দুতে মিলে যায়, ঠিক তখনই সূচনা হয় পরিবর্তনের। পপুলার মিউজিকে যা ঘটেছিল ‘বিটলস’র সঙ্গে। যেখানে চারজন ছেলে একই সময়ে একই স্থান থেকে উঠে এসে একটি নতুন সুরের জন্ম দেয় ।

ক্রীড়াঙ্গনে সাধারণত এমন পরিবর্তন আসে একটি নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের হাত ধরে, যার সঙ্গে পার্শ্বভূমিকায় থাকেন অনেকেই। তাদের প্রায় সমকক্ষ বললেও ভুল হবে না। ফুটবলে এমনটা ঘটেছিল পেলের বেলায়। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে চার বিশ্বকাপের তিনটিই জিতেছিল ব্রাজিল। সবগুলো আসরেই দলে ছিলেন পেলে।

ভারতীয় ক্রিকেটে সেই পালাবদলের নায়ক শচীন টেন্ডুলকার। শিশুসুলভ চেহারার এই ক্রিকেটারের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেটের ভাগ্যও বদলে যেতে থাকে। এই পালাবদলে পার্শ্বচরিত্রে থাকা অনিল কুম্বলে, জাভাগাল শ্রিনাথ, জহির খান, রাহুল দ্রাবিড়, বীরেন্দর শেবাগ, ভিভিএস লক্ষ্মণ, সৌরভ গাঙ্গুলী, হরভজন সিং ও মহেন্দ্র সিং ধোনিরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এদের মধ্যে অনেকেই জায়গা করে নেবেন ভারতের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের তালিকায়।

১৯৮৯ সালের নভেম্বরে টেন্ডুলকারের অভিষেকের আগে ২৫৭ টেস্ট খেলে ভারত জয় পেয়েছে ৪৩ ম্যাচে এবং হেরেছে দ্বিগুণের চেয়েও বেশি ম্যাচে, বাকিগুলো ছিল ড্র। টেন্ডুলকার যুগে ২১৭ ম্যাচ খেলে ভারতের জয় এসেছে ৭৮ ম্যাচে, বিপরীতে হেরেছে ৬০ ম্যাচ। কিন্তু ওই সময়ে ড্রও উল্লেখযোগ্য ছিল। তাছাড়া এই জয়ের কেবল সাতটি এসেছে সেনা দেশগুলো থেকে। এসব দেশে ড্র করাকে জয়ের সমান বলেই ধরা হতো- সেই মানসিকতা নিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখে ভারত।

তবে সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং এরপর তা সামনে এগিয়ে নিয়ে যান ধোনি। যার ফলে ঐতিহ্যবাহী জায়গাগুলোর বাইরেও খেলোয়াড় খুঁজে পেতে শুরু করে ভারত। ভালো খেলোয়াড় হলে যেখান থেকেই আসুক না কেন, তাকে সুযোগ দেওয়া হবে। যদিও ক্রিকেট বোর্ড ও বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্থাগুলোকে প্রায়শই রাজনীতির কারণে সমস্যায় পড়তে হয়েছে।

২০১৩ সালে টেন্ডুলকার অবসর নেওয়ার পর ১০৬ টেস্টের ভেতর ৫৮ ম্যাচে জিতেছে ভারত, হেরেছে কেবল ২৯ ম্যাচে। উল্লেখযোগ্যভাবে, মাত্র ১৯টি ম্যাচে ড্র করেছে। আগ্রাসন ও আত্মবিশ্বাস্য সামঞ্জস্য রেখে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে পরপর দুবার সিরিজ জিতেছে ভারত। তাই এটি আর শুধু ক্রিকেটীয় পরিবর্তন নয়, মানসিক পরিবর্তনও বটে।

অধিনায়ক হিসেবে বিরাট কোহলি মাঝেমধ্যে সীমালঙ্ঘন করেছেন। তবে টেস্ট ক্রিকেট ও জয়ের প্রতি প্যাশনেট ছিলেন তিনি, যে মনোভাব পুরো দলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৪ সালে অধিনায়ক হিসেবে নিজের প্রথম ম্যাচে ৩৬৪ রান তাড়া করতে যান অ্যাডিলেডে। ভারত জিতেই যাচ্ছিল প্রায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেবল হারতে হয় ৪৮ রানে।

একটি নতুন অ্যাপ্রোচ তৈরির ক্ষেত্রে এটি ছিল টার্নিং পয়েন্ট। ৬৮ ম্যাচে নেতৃত্ব দেওয়া কোহলি ড্র থেকে দূরে থাকতেই চাইতেন। এর মানে হলো ভারত সবসময় পজিটিভ ক্রিকেট খেলতে। নিজের অধিনায়কত্বে কেবল ১৬ শতাংশ ম্যাচ ড্র করেছেন তিনি। ইতিহাসের শীর্ষ ৬ জন অধিনায়কের ভেতর যা সবচেয়ে কম। এমনকি ক্লাইভ লয়েডও ৩৫ শতাংশ ম্যাচ ড্র করেছেন।  

কোহলি তার দলে অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় পেয়েছেন– চেতেশ্বর পূজারা, অজিঙ্কা রাহানে, রবিচন্দ্রন অশ্বিন, ইশান্ত শর্মা, রবীন্দ্র জাদেজা, এবং লোকেশ রাহুল। ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রগুলো বাইরে থেকে আবারও নতুন খেলোয়াড় আসতে থাকে।

আরেকটি মানসিক পরিবর্তন হলো, ভারত ঐতিহ্যগত পদ্ধতির দিকে আর অতিরিক্ত ঝুঁকেনি। খেলার ধরনের চেয়ে বরং খেলায় প্রভাব রাখাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। দ্রুতই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নাম কুড়ানো জাসপ্রিত বুমরাহ সম্ভবত ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ ফাস্ট বোলার। কিন্তু আগের প্রজন্মগুলোতে তিনি সফল হতেন কি না তা বলা কঠিন। তার আন-অর্থোডক্স বোলিংয়ের কারণে কোচরা বরং তাকে অন্য পেশা বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিতেন।

২০১১-১২ সালে যখন অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মাটিতে সবগুলো টেস্টে হেরে আসে ভারত, ক্রিকেট বোর্ড অবশেষে কিছু পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। সোনালী প্রজন্ম বিদায় নিচ্ছিল। ঘরোয়া ক্রিকেটের অকার্যকরিতা নিয়েও আলাপ হচ্ছিল। বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, পিচে পেসারদের সহায়তা থাকতে হবে। কিউরেটরদের নির্দেশ দেওয়া হয় পিচে ৩ থেকে ৮ মিলিমিটার পর্যন্ত ঘাস রাখার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর ফলাফল দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। প্রতিভাবান একটি পেস অ্যাটাক পাওয়ার পাশাপাশি পেস বোলারদের বিরুদ্ধে ব্যাটারদের দক্ষতাও বাড়িয়ে তোলে ভারত।  

বিদেশের মাটিতে ধারাবাহিকভাবে জিততে হলে পেস বোলার প্রয়োজন। ভারতীয় ক্রিকেটের লজ্জাজনক অধ্যায়গুলোতে পেস বোলারদের সামনে ব্যাটারদের দুর্বলতা বেশ ভালোভাবেই ফুটে ওঠে। ১৯৫২ সালে ম্যানচেস্টারে একই দিনে দুবার অলআউট হয়েছিল তারা। ফ্রেড ট্রুম্যান ও অ্যাালেক বেডসারের তোপে গুটিয়ে যায় ৫৮ ও ৮২ রানেই।

১৯৭৪ সালে লর্ডসে জেফ আর্নল্ড ও ক্রিস ওল্ডের খুনে বোলিংয়ে সামনে অলআউট হয় ৪২ রানেই।  এটি ক্রীড়া জগতের অন্যতম নৃশংস কার্টুনের জন্ম দেয়, যেখানে একজন মহিলা তার স্বামীকে টয়লেট থেকে বের হওয়ার সময় বলছেন, “তুমি বাড়ি যেতে পারতে। এখন তুমি পুরো ভারতীয় ইনিংস মিস করেছ। ”

যদিও ২০২০ সালে অ্যাডিলেডে ভারতের ৩৬ রানে অলআউট হওয়ার ঘটনা কোনো কার্টুনের জন্ম দেয়নি। যা স্রেফ অস্বাভাবিক বলেই ধরা হচ্ছিল, কারণ প্রতিটি ভালো বলেই উইকেট পড়ছিল সেখানে, বাজে বলের দেখাই মেলেনি বলতে গেলে। তবে তেমন এক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার জন্য অসাধারণ আত্মবিশ্বাস থাকা দরকার। সেই আত্মবিশ্বাসী ভারতকে পরবর্তীতে দুই টেস্টে জয় এনে দেয় এবং সঙ্গে সিরিজ জিততেও সাহায্য করে।

২০০২-২০০৪ সালের সময়ে ভারত পোর্ট অব স্পেন, লিডস, অ্যাডিলেড, মাল্টান এবং রাওয়ালপিন্ডিতে টেস্ট ম্যাচ জিতেছিল। তবে সিরিজ তারা জিতেছিল কেবল পাকিস্তানের বিপক্ষে। প্রবীণ লেখক ডেভিড ফ্রিথ তখন মনে করতেন যে, ভারতের ব্যাটিং লাইন-আপ ছিল ইতিহাসের সেরা। এই লাইন-আপে ভারসাম্য এবং সৌন্দর্যের এক বিরল সংমিশ্রণ ছিল।
কিন্তু সেই দল নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। এটি ভারতীয় ক্রিকেটের একটি আক্ষেপ যে, তাদের সোনালী প্রজন্মের দল প্রত্যাশা অনুযায়ী দাপট দেখাতে পারেনি।

তবে বর্তমান দলটি হৃদয় দিয়ে খেলে। অ্যাডিলেডের সেই ৩৬ ও লিডসের ৭৮ এর ঘটনা এই দলের খেলোয়াড়দের মানসিকতাকে তুলে ধরে যে, অতীতের খারাপ মুহূর্তগুলো তারা ভুলে যেতে পারে এবং কেবল ভালো সময়গুলোকেই মনে রাখতে পারে। একজন ব্যক্তির মধ্যে এই গুণ থাকাটা বিরল এবং একটি দলের মধ্যে তা আরো বিরল।

অতীতে সবসময় ভারতীয় দলে কয়েকজন অসাধারণ খেলোয়াড় ছিলেন যাদের ওপর পুরো দল নির্ভর করত। সুনীল গাভাস্কার আউট হলেই যেমন মনে হতো অর্ধেক দল এখানেই শেষ। স্পিনাররা ভালো না করলে কপিল দেব বাদে আস্থা রাখার মতো কেউ ছিলেন না। তারও যদি বাজে দিন যেত, তাহলে আর করার কিছুই ছিল না।

৬০ এর দশকে বিদেশের মাটিতে ভারত কেবল একবারই সিরিজ (নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে) জিতেছিল। নবাব মনসুর আলী খান পাতৌদির সেই রোমান্টিক প্রজন্ম, যাদের পেশাদারিত্বের চেয়ে খেলার প্রতি ভালোবাসাটাই বেশি ছিল। তবে তা ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ যতটা টেন্ডুলকারের নেতৃত্বধানী প্রজন্ম। যখন ভারত অসাধারণ ধারাবাহিকতার সঙ্গে পারফরম করতে শুরু করে।

এসবই হয়েছে কোহলি-নেতৃত্বাধীন পেশাদার যুগের আগে। ২০০৯ সালে ভারত যখন প্রথমবারের মতো র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষে উঠল, তখনো তারা অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলঙ্কার মাটিতে সিরিজ জেতেনি। এখন কেবল দক্ষিণ আফ্রিকাই বাকি আছে।  

ভারতীয় ক্রিকেট এখন অনেক এগিয়ে গেছে এবং বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও রবীন্দ্র জাদেজার মতো বর্তমান তারকাদের শেষ দেখতে যাচ্ছি আমরা। যদিও ইতোমধ্যে রিশাভ পান্ট, বুমরাহ, শুবমান গিল, যশস্বী জয়সওয়াল এবং অনেক প্রতিভাবান পেস বোলার দেখিয়েছেন তাদের জায়গা নিতে তারা প্রস্তুত।

নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়া পাঁচ টেস্ট খেলবে ভারত। হঠাতই চাপটা এখন অস্ট্রেলিয়ার ওপর। টেন্ডুলকার প্রজন্মের তৈরি করে দেওয়া শক্ত ভিতের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে কোহলি-রোহিত প্রজন্ম। যদি প্রয়োজন হয়, চেন্নাই টেস্টের পর জয়-পরাজয়ের সংখ্যাটিই এই নতুন ভারতের প্রমাণ।  
 

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০২৪

এএইচএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।