ঢাকা: বিগ শটে তিনি নিজেকে দিলেন দশে দশ। আর ডিফেন্সে দিলেন দশে চার।
তবে, ঘুরে-ফিরে সাব্বিরকেই নিজের ব্যাটিংয়ে আদর্শ মানেন হাবিবুর শেখ মুন্না। খুলনার এ তরুণ ব্যাটসম্যান নিজেকে উইকেটকিপার হিসেবেও মানিয়ে নিতে চান। আর সে লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিকেএসপির ছাত্র মুন্না।
বিকেএসপি থেকে জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম, সাবেক অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয়, নাসির হোসেন, এনামুল হক বিজয়, মুমিনুল হক, সৌম্য সরকার, সোহরাওয়ার্দী শুভ, শামসুর রহমান, মোহাম্মদ মিঠুন, আবদুর রাজ্জাক, নাঈম ইসলাম, আল শাহরিয়ার, রাকিবুল হাসানের মতো দেশ সেরা তারকারা। লাল-সবুজের বাংলাদেশকে ক্রিকেট বিশ্বের কাছে আরও উপরে তুলে ধরতে প্রস্তুত বিকেএসপি’র সম্ভাবনাময়ী উঠতি তারকারা। প্রতিষ্ঠানটির ক্রিকেট কোচ মাসুদ হাসানকে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটার তৈরির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলে উঠলেন, একজন সাকিব, একজন মুশফিক আর একজন দুর্জয় কিন্তু বারবার আসেনা। আমার এখানে এমন কিছু ছাত্রকে পেয়েছি, যাদের ইঙ্গিত দিলেই তারা বুঝে নেয় তাদের কী করণীয়। এরাই এক সময় জাতীয় দলকে সার্ভিস দেবে, দেশের ক্রিকেটকে শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে যাবে।
কোচের চোখে তাদেরই একজন খুলনার কিশোর মুন্না।
ডেকে নিয়ে কিছুক্ষণ কথা হয় মুন্নার সাথে। গল্প করার ছলে তিনি জানালেন, ‘আমার যখন দশ বছর বয়স তখন থেকে আমি ক্রিকেট অনুশীলন করি। খুলনার বাড়িতে থাকার সময় বৃষ্টির কারণে মাঠে খেলতে যেতে পারতাম না। তখন ঘরের ভেতর ক্রিকেট খেলতাম। একা একাই খেলতাম। ’ একা একা কি করে ক্রিকেট খেলা যায় চিন্তা করছি, বুঝতে পেরে মুখে হাসি নিয়ে মুন্না জানালেন, ‘আমি ঘরের ভেতর মশারি টাঙিয়ে মোজা বেধে তার ভেতরে বল ঢুকিয়ে ব্যাটিং করতাম। ’
ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় ক্রিকেট কোচিং একাডেমি থাকে, ক্লাবে অনুশীলন করার সুযোগ থাকে। সেগুলো ছেড়ে বিকেএসপিতে আসার কারণ কি জিজ্ঞেস করতেই আবারো মুখে একগাল হাসি নিয়ে মুন্না বললেন, ‘বিকেএসপিতে রয়েছেন অনেক দক্ষতাসম্পন্ন স্যার (কোচ)। এখানের সুযোগ-সুবিধা অন্যান্য জায়গার থেকে অনেক উন্নত। স্যারদের সব সময় পাশে পাচ্ছি। এখানে একটু ভালো করলেও স্যাররা যেমন ধরে ফেলতে পারেন, তেমনি কিছুটা খারাপ করলেও তারা ধরে ফেলেন আমার সমস্যাগুলো। সঙ্গে সঙ্গেই তারা আমাকে বুঝিয়ে দেন, ভুলগুলে শুধরে দেন। বিকেএসপি ছাড়া এটা বাইরে কোথাও পাবো না। ’
মুন্না জানালেন, ছোটবেলায় ক্রিকেটের পোকা মাথায় ঢুকিয়েছিলেন আমার আব্বু। তিনি একজন আইনজীবী। তার ইচ্ছেতেই ক্রিকেটে আসা। তবে, আমার আগ্রহও কম ছিল না। আব্বু আমাকে সঙ্গে করে বিকেএসপির পরীক্ষা দিতে নিয়ে আসেন। বিকেএসপি’র আর সবার মতো জাতীয় দলের খেলার স্বপ্ন দেখেন মুন্না। এ তরুণ ক্রিকেটার বলেন, ‘জাতীয় দলের স্বপ্ন কে না দেখে? তবে, সেখানে সুযোগ পাওয়া সহজ নয়। এজন্য আমাকে নিজের দক্ষতা বাড়িয়ে নিতে হবে। বিকেএসপি থেকে যে শিক্ষাগুলো পাচ্ছি, তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে চাই। এরপর অনূর্ধ্ব ১৫, ১৭, ১৯ দলে সুযোগ করে নিতে হবে। মানে ধাপে ধাপে আমাকে এগুতে হবে। ’
নিজেকে আরও অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে হবে জানেন মুন্না। পরিবার ছেড়ে বিকেএসপি’তে এসে আগে খারাপ লাগতো তার। মুন্না যোগ করেন, ‘আব্বুর কথা খুব বেশি মনে পড়ত। পরিবারের বাকিদের কথা মনে পড়ে কষ্ট হতো। তবে এখন আর খারাপ লাগেনা। মানিয়ে নিয়েছি সবার সঙ্গে, সব কিছুর সঙ্গে। আমাকে ক্রিকেট নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। ছুটিতে বাড়িতে গেলে সবার সঙ্গে মিশতে পারি, অনেক আনন্দ করি। সবার সাথে থাকার মজাটাই অন্যরকম। তবে, এখানকার সতীর্থরা আমার খুব কাছের। তাদের সঙ্গে জীবনটা উপভোগ করছি। তারা আমাকে খেলা এবং খেলার বাইরেও অনেক বিষয়ে সাহায্য করে। ’
বিকেএসপিরর কোচদের হাতে তৈরি হয়েছেন দেশসেরা বহু ক্রিকেটার। কোচদের প্রত্যাশা পূরণে সর্বদা ব্যস্ত মুন্না জানান, ‘বিকেএসপিতে আসার আগে আমি অনেক কোচের কাছে গিয়েছিলাম। তাদের কাছে অনেক কিছু শিখেছি। তবে, কোনো কোচ আমার একটা দুর্বলতা ধরিয়ে দিতে পারেননি। আমি নিজেও জানতাম না সেটা। শুধু বুঝতাম এভাবে হবেনা। প্রতিনিয়ত কিছু একটা ঘটার কারণে আমার খেলায় বাজে প্রভাব পড়ছে। কিন্তু, বিকেএসপিতে এসে আমার দুর্বলতা স্যাররা প্রথম দিকেই ধরে ফেলেন। আমি জানতে পারি, উপর থেকেই আমার ব্যাট ঘুরে যাচ্ছে। তারা আমাকে যেভাবে শিখিয়ে দিলেন, আমি চেষ্টা করতে থাকি। এখন আমি স্বাভাবিকভাবেই নিজের ব্যাট চালাতে পারি। ’ নিজের পারফর্মের উপর বিশ্বাস আছে বলেই মুন্না জানালেন, বিকেএসপি থেকে বের হওয়ার পর হয়তো কোনো বড় ক্লাব আমাকে তাদের হয়ে খেলার প্রস্তাব দেবে। তবে, সেটা নিয়ে এখনই কিছু ভাবছি না। আপাতত বিকেএসপি’র শিক্ষাগুলো নিজের ভেতরে আয়ত্বে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি। নিজের খেলার উন্নতি করতে যা যা প্রয়োজন করে যাব। স্যারদের প্রত্যাশা পূরণে আমার চেষ্টা সবসময়ই থাকবে।
যারা বিকেএসপিতে সুযোগ পায়না তাদের নিরাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে জানান মুন্না, ‘এখানে সবাই সুযোগ পাবেনা। আবার জাতীয় দলেও সবাই বিকেএসপি’র হবেনা। তাই আমাদের বয়সী যারা জাতীয় দলের স্বপ্ন দেখছো, তাদের বলব, যে যেখানেই ক্রিকেট প্রাকটিস করো না কেন, তোমাদের আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। যদি তুমি অনেকের সঙ্গে প্রাকটিস করো, তবে স্যাররা তোমার ভুলগুলো কখনো কখনো ধরতে পারবেন না। তোমাকেই তোমার ভুলগুলো ধরতে হবে। তোমাদের ভেতরের দুর্বলতাগুলোকে খুঁজে বের করে স্যারদের কাছে যেতে হবে। তাদের বলতে হবে। তাদের দেখানো পথে এগিয়ে যাও, দেখবে তুমি ভালো করবে। মুন্না আরও যোগ করেন, ‘তুমি যদি ব্যাটসম্যান হও, স্যাররা তোমার যে দুর্বল শটগুলো দেখিয়ে দেবেন, সেগুলো তুমি আলাদা ভাবে অনুশীলন করো। দেখবে অনুশীলনের সঙ্গে সঙ্গে তোমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে। নিজেকে ভালো করে গড়তে হলে, বড় বড় ক্রিকেটারদের খেলা দেখার পাশাপাশি তাদের লাইফস্টোরি পড়তে হবে। আমরা এখানে যারা আছি, বৃষ্টির সময় ইনডোরে অনুশীলন করার সুযোগ পাই। কিন্তু, তোমরা যারা এখানে নেই, ব্যাটিংয়ে নিজেদের উন্নতি করতে হলে বৃষ্টির সময়ও অনুশীলন থামিয়ে রেখো না। প্রয়োজনে ঘরের মধ্যেই কটের বল (এক ধরনের প্লাস্টিকের বল) দিয়ে অনুশীলন করো। পারলে আমার মতো মোজার ভেতর বল ঢুকিয়ে ব্যাটিং অনুশীলনটা চালিয়ে যাবে। যে শটগুলোতে তুমি বেশি দুর্বল সেগুলো নিয়ে তুমি বেশি বেশি শটস খেলে দেখতে পারো। ’
বিকেএসপি’তে ভর্তি হওয়া শত শত মুন্না থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটে আসবে আন্তর্জাতিক মানের সেরা ব্যাটসম্যান, বোলার, উইকেটরক্ষক, অলরাউন্ডার। তাদের হাত ধরেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট। এশিয়ার পরাশক্তি লাল-সবুজের দলটি এই মুন্নাদের মাধ্যমে বিশ্বশিরোপা ঘরে নিয়ে আসবে। ক্ষুদে এ টাইগারদের ব্যাটের আঁচরে অচিরেই ক্ষত হবে বিশ্বের তাবৎ বোলাররা।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, ০২ নভেম্বর ২০১৫
এমআর