ঢাকা: একটি জোনাকির আলো কী এমন গুরুত্ব রাখে! বিশেষ করে যখন ফ্লাড লাইটের তীব্র বাল্বগুলো আলোর বন্যায় ভাসায় রাতের ক্রিকেট মাঠ! কিন্ত সে আলো যদি হয় অনেক জোনাকির, শত শত হাজার হাজার জোনাকির! তাহলে! ফ্লাড লাইটের আলোর বন্যা ছাপিয়ে তা চোখে পড়ে। আর জোনাকির আলোরা যখন এই জ্বলে আর এই নেভে তাতে যে আলেয়া তৈরি হয় তা আপনাকে বিষ্ময়েও ভাসিয়ে দেয়।
রোববার (২৮ ফেব্রুয়ারি) রাতে মিরপুর শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সেই জোনাকির আলো দেখেছে হাজারো মানুষ। ফ্লাড লাইটের আলোকে ছাপিয়ে জেগে ওঠা সেই আলোতে হেসেছে সবাই। আর যাদের জন্য এই আলোর প্রজ্জ্বলন, জোনাকির নাচন তাদেরতো ভালো লেগেছেই। দর্শকের এই অভিনব অভিবাদনে উজ্জীবিত টাইগার ক্রিকেটাররা জয় এনেছেন দর্শকদের জন্যতো বটেই, দেশের জন্যও।
এত জোনাকি কোথা থেকে এলো? সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সে জোনাকির অবস্থান ছিলো ক্রিকেট ভক্ত বাঙালির মস্তিষ্কে। যা তাদের মোবাইল ফোনের বাল্বের মধ্য দিয়ে আলো হয়ে ফুটেছে। এ এক অভিনব অভিবাদনের ভাষা। দেশের ক্রিকেটারদের উদ্দীপণা যোগানোর জন্য এ এক অনন্য সাধারণ কাজ।
টসে জিতে বাংলাদেশ ব্যাটিং করার শুরুতেই যখন তিন উইকেট হারিয়ে বসে তখন কিন্তু গ্যালারি নিশ্চুপ। কিন্তু ব্যাট হাতের সাব্বিরের ঝলসে ওঠা। ১০টি চার আর তিনটি ছক্কায় তার অনবদ্য ৮০ রানের ইনিংস টি-টোয়েন্টির মাঠে অসাধারণ পারফরম্যান্স দর্শককে মুগ্ধ করে। আর তারই জন্য সাব্বিরকে অভিবাদন জানাতে প্রথম একবার ওঠে গ্যালারিতে জোনাকির নাচন। দলের সিজনড আর সেরা ভরসার সাকিবও ততক্ষণে ৩৪ বলে ৩২। সুতরাং জোনাকি ফোটা সেই ধন্যবাদের আলো সাকিবের মুখেও গিয়ে পড়ে। সব মিলিয়ে দলের সংগ্রহ গিয়ে দাঁড়ায় ১৪৭।
এরপর বাংলাদেশ দল যখন বল হাতে মাঠে নামে আর প্রথম দিকে একটি আঘাতের পর দীর্ঘ সময় ধরে আর উইকেট পতন হচ্ছিলো না তখন কিন্তু গ্যালারিতে পিনপতন নিরবতা। গোটা তিনেক, একটু কঠিন হলেও, ক্যাচ মিস হয়ে যাওয়ায় হতাশাই যেনো বাড়ছিলো। তারই মাঝে দু-চারটি চার-ছক্কা হাকিয়ে যাচ্ছিলেন শ্রিলংকার দিলশান-চান্দিমাল। লাইভ পেলে হাত খোলে সে আর নতুন কি? আর সে পারফরম্যান্স গ্যালারিতে গুটিকয় শ্রিলংকান ক্রিকেট ভক্তকে উজ্জীবিত করবেই বৈকি। তারা তখন গান ধরে.. শ্রীলঙ্কা জিতেগা...। আর ঢোলক বাজায়। স্লোগান ধরে শ্রীলংকা... শ্রীলংকা।
দলের করুণ দশা! এমন সময় প্রতিপক্ষের এই আনন্দ সহজে নেওয়ার পাত্র বাঙ্গালি নয়! তার তাই ওই গুটিকয় শ্রীলংকান দর্শক যখন দেশের নাম বলে চিৎকার দিচ্ছিলো তখন বাংলাদেশি ক্রিকেট ভক্তরা তাদের ভূয়া...ভূয়া বলে ধুয়ো দিচ্ছিলো।
দলীয় ২০ রানে শ্রীলংকাকে দিলশানের উইকেটটি হারাতে হয়। সেটি ছিলো ইনিংসের চতূর্থ ওভার। সাকিবের বলে সৌম্যর নেয়া ক্যাচটি কঠিন ছিলো বলা চলে। কিন্ত তাতেই দর্শকের মন গলে। তবে উল্লাস হয়, কিন্তু আলো জ্বলে না। এদিকে একটা কাজের কাজ কিন্তু করে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশের বোলাররা। বোলিং ইকোনমি ছিলো সবারই নিয়ন্ত্রণে। ফলে উইকেট না গেলেও শ্রীলংকার স্কোর বোর্ডে রানের অংক উদ্বেগের পর্যায়ে যায়নি। দ্বিতীয় আঘাতটি হানে ১১তম ওভারে। এবার ক্যাচে তাসকিন, বলে রিয়াদ। আর বধ চান্দিমাল। এগুতে থাকে ম্যাচ। একটু পরেই ১২তম ওভারে সাকিব ফেরান জয়সুরিয়াকে। স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলে। আর ১৩তম ওভারে মুস্তাফিজের কাটারে এলবিডব্লিউ হয়ে ফেরেন থিসারা। এরই মধ্যে ক্রিকেট বোদ্ধা দর্শক কিন্তু বুঝে নেয়, ম্যাচ তখন বাংলাদেশের হাতে। একটি দুটি করে জোনাকিও জ্বলতে শুরু করে। এক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় রান রেট শ্রীলংকার নাগালের বাইরে যেতে থাকে। তখন গ্যালারির দর্শকেরা ফের অভিবাদন জানাতে মেতে ওঠে টাইগারদের। শত শত জোনাকি জ্বলে ওঠে গ্যালারিতে। এরপর হাজার হাজার। আর তা ফ্লাড লাইটের আলো ছাপিয়ে যায়। সঙ্গে বাংলাদেশ বাংলাদেশ স্লোগান।
শ্রীলংকার দর্শকরা তখন একটা দারুণ (!) কাজ করে। একটু আগে বাংলাদেশি দর্শকদের ভূয়া বলে ধুয়ো তোলার সেই বিষয়টি তারা ফিরিয়ে দেয়। বাংলাদেশিদের স্লোগান শেষ হলেই ওরা সমস্বরে বলতে থাকে ভূয়া...ভূয়া। বাঙালি তাতে মজাই পায়। কেউ কেউ বলতে থাকে... বাহ এরা তাহলে 'ভূয়া' শব্দটি শিখে গেছে। বেশতো প্রতিপক্ষের কোনো আনন্দে ধুয়ো তোলার এই বাংলাঅস্ত্র এখন শ্রীলংকানরাও শিখে নিলো।
কিন্তু গুটিকয় শ্রীলংকানের পুরোপুরি চুপসে যেতে আর সময় লাগেনি। আস্কিং রান রেট যখন ১৫'র ঘরে তখন নখ কামড়ানো ছাড়া আর কীই গতি।
ওদিকে দলকে অভিবাদন জানাতে গ্যালারিতে আবার আলোর নাচন। আবার বাংলাদেশ.. বাংলাদেশ স্লোগানে ফেটে পড়া। এটাই বাংলাদেশের ক্রিকেট। এটাই এখন ক্রিকেটের চিত্র। টাইগাররা যতবার জয় আনবে, এমন আলো প্রজ্জ্বলিত হবে। ফ্লাড লাইটের আলো তার কাছে হয়ে উঠবে তুচ্ছ থেকে আরো তুচ্ছ।
বাংলাদেশ সময়: ০৭২৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০১৬
এমএমকে