মিরপুর থেকে: মিরপুরের মাঠভর্তি দর্শক, টিএসসিতে জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনে উত্তাল তারুণ্য, মাঠের বাইরে দেশের সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যায়ের প্রতিটি হলে এলইডি টিভির সামনে শিক্ষার্থীরা, দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাখো চায়ের দোকান, লঞ্চ ঘাট-বাস টার্মিনাল-রেলস্টেশন আর ঘরের টিভি সেটের সামনে বসে আপামর জনতা। বলার অপেক্ষা রাখে রোববার (০৬ মার্চ) সন্ধ্যায় পুরো বাংলাদেশের চিত্র হবে এমনই! মাশরাফিরা ভারতের বিপক্ষে এশিয়া কাপ শিরোপা জিতে ইতিহাস গড়বেন এমন প্রত্যাশায় একসুতোয় গেঁথে উঠবে মাঠ ও মাঠের বাইরে থাকা ১৬ কোটি প্রাণ।
স্বাগতিক হওয়ায় টাইগারদের ওপর প্রত্যাশার চাপ থাকবে আকাশচুম্বি। তবে আশার কথা হলো, টাইগার দলপতি মাশরাফি স্বাগতিক দর্শকদের উপস্থিতি ও তাদের প্রত্যাশাকে চাপ হিসেবে নিচ্ছেন না। ম্যাচ জয়ের প্রেরণা হিসেবেই নিচ্ছেন ১৬ কোটি প্রাণের প্রত্যাশাকে।
‘আমাদের ম্যাচে দর্শক সবসময়ই পাশে থাকেন। তাদের জন্যই আমাদের এতদূর আসা। তাদের অনুপ্রেরণাতেই আমরা ভালো খেলে থাকি। তারা আমাদের ম্যাচের বড় একটি অংশ। ’
ঠিক এভাবেই ভারতের বিপক্ষে এশিয়া কাপের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচের আগের দিন শনিবার (০৫ মার্চ) ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে মাঠে দর্শকদের সরব উপস্থিতির প্রয়োজনীতা জানালেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা।
আর দর্শকদের এমন ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে রোববার (৬ মার্চ) এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচটি শুরু হবে বাংলদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়।
সন্দেহ নেই ভারত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সব সময়েই শক্তিশালী দল। তাছাড়া আইসিসি টি-টোয়েন্টি র্যাংকিংয়ে ধোনিরা ১ নম্বরে আর বাংলাদেশের অবস্থান ১০ নম্বরে। শিরোপা নির্ধারণী এই ম্যাচে মাশরাফিদের খেলতে হবে মূলত এমন বাস্তবতাকে সামনে রেখেই। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো বিশ্বসেরা এই দলটিকে মাশরাফি সমীহ করলেও ভয় পাচ্ছেন না একেবারেই। আর শিরোপা জিততে তাদের বিপক্ষে অসাধারণ বা অস্বাভাবিক খেলা নয় বরং স্বাভাবিক খেলাটি খেলেই দারুণ কিছু করতে চাইছেন তিনি।
‘ভারত টি-টোয়েন্টির এক নম্বর দল। তারা শুধু টি-টোয়েন্টি ফরমেটেই নয়, টেস্ট এবং ওয়ানডেতেও ভালো মানের দল। তবে, আমরা আমাদের সেরা খেলাটি খেলেই শিরোপা জিততে চেস্টা করবো। ’
ভারতের বিপক্ষে এ পর্যন্ত তিনটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ যেখানে একটিতেও তারা জয়ের দেখা মেলেনি। দলটির বিপক্ষে এমন পরিসংখ্যান সামনে রেখে ভারতের বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপের বিপক্ষে রোববার মাঠে নামবে লাল-সবুজের দল।
দলটির বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপের কথা স্বীকার করে তা গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুঙ্কার দিলেন মাশরাফি। ‘ভারতের ব্যাটিং অর্ডার বেশ শক্তিশালী। টপঅর্ডারের ছয়জন ব্যাটসম্যান রয়েছে যারা যেকোনো জায়গা থেকে ম্যাচ বের করে নিতে পারেন। তবে, আমাদের বোলাররা ছেড়ে কথা বলবে না। ’
এদিকে, স্বাগতিক হওয়ায় ভারতের বিপক্ষে এই ম্যাচে কন্ডিশন মাশরাফিদের পক্ষেই কথা বলছে। হোম কন্ডিশনের এমন সুযোগ কাজে লাগিয়ে টাইগাররা জয় পেতেই পারেন। তবে মাশরাফি মনে করেন, শুধু কন্ডিশন অনুকূলে থাকলেই হবে না। ম্যাচের শুরু ও শেষটা অবশ্যই ভালো করতে হবে। ’
এদিকে ম্যাচে নিজেদের পাওয়ার প্লে’র ছয় ওভারকে গুরুত্ব দিয়ে টাইগার অধিনায়ক জানান, ‘ভারতের বিপক্ষে আমরা প্রথম ছয় ওভার ভালো বল করতে চাই। এটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ’
দলের তরুণদের বড় শক্তি বলে মনে করেন দলনেতা মাশরাফি। ভারতের বিপক্ষে শিরোপা নির্ধারণী এ ম্যাচে খেলতে দলের তরুণ ফাস্ট বোলার মুস্তাফিজুর রহমান। তার অনুপস্থিতি মাশরাফিকে ভাবালেও আলআমিন হোসেন ও তাসকিন আহমেদের পেস নৈপূণ্যে ভারতের বিপক্ষে দারুণ কিছু করার অভয় যোগাচ্ছে তাকে।
‘আমরা আমাদের সেরা খেলোয়াড় ছাড়াই খেলছি। এটা অবশ্যই একটা ব্যাপার। তবে, আলামিন-তাসকিন ভালো খেলছে, এটা আমাদের মতো একটা উঠতি দলের জন্য সু-সংবাদ। ’
গেল বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে আইসিসি বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ। কোয়ার্টার ফাইনালের ওইম্যাচই মাশরাফির জীবনের সবচেয়ে বড় ম্যাচ ছিল। আর এবার জীবনের অন্যতম বড় ম্যাচ হয়ে এলো এশিয়া কাপের ফাইনাল। যা জিততে এক রকম মুখিয়েই আছেন তিনি।
এবার দেখার বিষয় হলো ভারতের বিপক্ষে জয়টা কতটা নিপুণ হাতে তুলে নিতে পারে টাইগাররা। সেই কাজটি যদি করতে পারেন তাহলে প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপ জয়ের ইতিহাসটাও রচিত হবে মাশরাফির নেতৃত্বে।
ফাইনালে নামার আগে শনিবার (৫ মার্চ) দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মিরপুরে অনুশীলন করেছে স্বাগতিক বাংলাদেশ ও ভারতীয় ক্রিকেট দল। ইনডোরে ব্যাট-বলের কঠোর অনুশীলনে ঘাম ঝড়ায় মাশরাফি বাহিনী। আর একাডেমি মাঠে অনুশীলন করে মহেন্দ্র সিং ধোনির দল।
ফাইনালে বাংলাদেশের সম্ভাব্য স্কোয়াড: তামিম ইকবাল, সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমান, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, নুরুল হাসান সোহান/মোহাম্মদ মিঠুন, মাশরাফি বিন মর্তুজা, আল-আমিন হোসেন, তাসকিন আহমেদ ও আবু হায়দার রনি।
ফাইনালের এই মহারণে প্রাণপণে জিততে চাইবে ধোনির দল। শক্তিমত্তায় স্বাগতিক বাংলাদেশের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে থাকা দলটি এবারের এশিয়া কাপের শুরু থেকেই ফেবারিটের তকমা গায়ে লাগিয়েছে। গেল জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে স্বাগতিকদের ৩-০ তে হোয়াইট ওয়াশ করে এশিয়া কাপে এসেছে ধোনি বাহিনী। আর এশিয়া কাপে এসে দলটির অদম্য পারফরমেন্স প্রতিটি দলের বিপক্ষেই জয় এনে দিয়েছে। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ফাইনালে বাংলাদেশের বিপক্ষে জয় পেতে দলটি আশার ভেলা ভাসাতেই পারে।
এশিয়া কাপের এবারের আসরের প্রথম ম্যাচেই স্বাগতিক বাংলাদেশের বিপক্ষে ৪৫ রানের জয় পেয়েছে ভারত। ওই ম্যাচে বাংলাদেশের বোলিং তোপের সামনে অনেকটাই চাপে পড়ে গিয়েছিল টিম ইন্ডিয়া। মাশরাফি-আলামিনদের আক্রমণাত্মক বোলিং দলীয় ৪২ রানে ভারতের টপ অর্ডারকে সাজঘরে পাঠিয়ে দেয়।
তারপরেও সেই চাপ সামলে রোহিত শর্মা ও হারদিক পান্ডের ব্যাটে ভর করে শেষ পর্যন্ত দারুণভাবে খেলায় ফিরে ভারত শেষ পর্যন্ত জয় তুলে নেয়।
প্রথম ম্যাচে বাংলদেশের বিপক্ষে জয় পাওয়া ভারত তাদের এই জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চাইছে ফাইনালেও। তবে আগের মতো নয়, এবারের জয়টি পেতে তারা নাকি ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করবেন বলে জানালেন ভারত টিম পরিচালক রবি শাস্ত্রী। ‘আমাদের দলে আছে এক ঝাঁক অভিজ্ঞ খেলোয়াড়, যাদের নিয়ে একটি ভিন্ন আঙ্গিকে আমরা এই ম্যাচে টিম বাংলাদেশকে মোকাবেলা করবো। ’
আর এই ম্যাচে মাশরাফিদের বিপক্ষে জয় পেতে দলের এক বা দুইজন খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভর না করে পুরো দলের ওপর ভরসা করছেন রবি শাস্ত্রী।
‘ভারতের ক্রিকেটে এক বা দুজন খেলোয়াড়ের নির্ভরশীল দল নয়। সবাই এ দলে সম্মিলিতভাবে পারফর্ম করে বলেই দলটি টিম ইন্ডিয়া নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। ’
এদিকে, পিচ বা উইকেট প্রতিটি ম্যাচেই বেশ গুরুত্ব পায়। সেই ধারাবাহিকতায় এ ম্যাচেও মিরপুরের উইকেট দু’দলের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। উইকেট কেমন আচরণ করবে তার ওপরে ম্যাচের ভাগ্য অনেকটাই নির্ভর করে।
পিচ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে রবি শাস্ত্রী বলেন, ‘দেখুন পিচ আমাদের হাতে নেই। আমাদের কাজ খেলে যাওয়া। তাই পিচ যেমনই হোক না কেন আমাদের ছেলেরা তাদের স্বভাবসুলভ খেলাটিই খেলবে। ’
ভারতের সম্ভাব্য একাদশ: রোহিত শর্মা, শিখর ধাওয়ান, বিরাট কোহলি, সুরেশ রায়না, যুবরাজ সিং, হারডিক পান্ডে, মহেন্দ্র সিং ধোনি, রবীন্দ্র জাদেজা/হরভজন সিং, জাসপ্রিত বুমরাহ, আশিষ নেহরা, রবীচন্দ্রন অশ্বিন।
বাংলাদেশ সময়: ০১৩২ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০১৬
এইচএল/এমজেএফ/