লর্ডসের ফাইনালে ১০০ ওভারের খেলা শেষেও দুই দলের মধ্যে কোনো পার্থক্য পাওয়া যায়নি। কারণ দুই দলের সংগ্রহ ২৪১ রান।
এরপর টানটান উত্তেজনার সুপার ওভারেও সমতা! অর্থাৎ ১০২ ওভারের খেলা শেষে দুই দলের স্কোর সমান, ২৫৬। ভাবা যায়? শেষ পর্যন্ত মূল ইনিংসে বাউন্ডারির সংখ্যায় এগিয়ে থাকায় শিরোপা যায় খেলাটির জন্মদাতাদের ঘরেই। আর টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনাল থেকে খালি হাতে ফিরতে হয় কিউইদের।
অবিশ্বাস্য ওই ম্যাচ জিতে নেওয়ার পর বাঁধভাঙা উল্লাসে মাতে ইংলিশরা। কিন্তু অন্যদিকে ভগ্নহৃদয় আর অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে মাঠেই বিমর্ষচিত্তে বসে পড়েন নিউজিল্যান্ডের খেলোয়াড়রা। পুরো ম্যাচে সবকিছু ঠিকঠাক করার পরও শুধু বাউন্ডারি কম হাঁকানোর সাজা এভাবে পেতে হবে কেউ ভাবতে পেরেছিল? শুধু কিউইরা কেন, পুরো ক্রিকেটবিশ্বই সেদিন দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল।
সেই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আসুন জেনে নিই ফাইনাল ম্যাচটি ক্রিকেটভক্তদের কোন পাঁচটি বিষয় শিক্ষা দিয়ে গেছে-
ভদ্রলোকেরাও দ্বিতীয় হতে পারে
সেদিনের ফাইনালে নিউজিল্যান্ড এবং তাদের অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন ক্রিকেটবিশ্বের প্রায় সবার সমর্থন পেয়েছিলেন। ভদ্রলোকের খেলাটির প্রকৃত উদাহরণ এই দলটি বিশ্বকাপ না জিতলেও সমর্থকদের হৃদয় ঠিকই জিতে নিয়েছিলেন। মেলবোর্নে ২০১৫ বিশ্বকাপের ফাইনালে ব্র্যান্ডন ম্যাককালামের দল অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে যাওয়ার পর কেন উইলিয়ামসনের দলের কাছে সবার প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। বিশেষ করে টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেভারিট ভারতকে যেভাবে তারা সেমি থেকে বিদায় করে দিয়েছিল এরপর নিশ্চিত চ্যাম্পিয়ন ভাবা হচ্ছি তাদেরই। কিন্তু বড়দিনে ভদ্রলোকেরা হেরে গেলেন।
হেরেও প্রসন্ন থাকুন
সেদিন হেরে যাওয়া দলটির অধিনায়ক উইলিয়ামসন ছাড়া অন্য কেউ হলে কেমন হতো? নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এটা নিশ্চিত, অন্য কোনো অধিনায়ক সহজে এই হার মেনে নিতেন না। এমনকি ক্রিকেটবিশ্বের অনেকেই বাউন্ডারির হিসাবটাকে মেনে নিতে পারেননি। অনেকে একে অন্যায় হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে কিউই অধিনায়ক ছিলেন শান্ত, মুখে স্মিত হাসি।
উইলিয়ামসন বলেন, ‘এটা (বিশ্বকাপ শিরোপা) আমাদের কপালে ছিল না। ইংল্যান্ডকে অভিনন্দন। আসরটা তাদের জন্য দুর্দান্ত কেটেছে এবং এটা তাদের প্রাপ্য। দিনশেষে ফাইনালটা কেউ হারেনি, কিন্তু কেউ তো শিরোপা জিততোই। ’ কিউই অধিনায়কের এমন অসাধারণ আচরণ সেসময় ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। তাই, হেরেও সমর্থকদের চোখে বিজয়ী আসলে নিউজিল্যান্ড।
ব্যর্থতা থেকেও শেখার আছে
২০১৫ বিশ্বকাপে অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রুবেল হোসেনের বিধ্বংসী স্পেলের কথা মনে আছে? যা ইংল্যান্ডের মতো টপ ফেভারিটকে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় করে দিয়েছিল। টাইগারদের কাছে হেরে ওই বিদায় নেওয়ার পর নিজেদের বদলে ফেলেছিল ইংল্যান্ড। ৩ বছর বাদে অস্ট্রেলিয়ার বোলিং আক্রমণকে উড়িয়ে দিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ ইনিংসের (৪৮১) রেকর্ড গড়ে মরগ্যানবাহিনী। এক বছর বাদে বিশ্বকাপে তাদের ব্যাটিং লাইনআপ হয়ে ওঠে অদম্য।
২০১৫ বিশ্বকাপেও ইংল্যান্ডের অধিনায়ক ছিলেন ইয়ন মরগ্যান। ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সেই তিনিই ইংল্যান্ডের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতে ইতিহাস গড়েন। অধিনায়ক মরগ্যান, ইসিবি’র সাবেক পরিচালক অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস এবং কোচ ট্রেভর বেলিস মিলে ইংল্যান্ড দলটির খোলনলচে পাল্টে ফেলেন। মরগ্যান পরে জানিয়েছেন, ২০১৫ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার খেলার ধরনকে অনুসরণ করেই সাফল্য পেয়েছেন তারা।
পরিকল্পনার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে
ইংল্যান্ড শুধু নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার খেলার ধরনই অনুসরণ করেনি, বরং সংক্ষিপ্ত পরিসরের ক্রিকেটে নিজস্ব স্টাইলও তৈরি করেছে। পরিকল্পনা সাজিয়ে সেইমতো খেলোয়াড়ও দলে টেনেছে তারা। দলে আগ্রাসী ফাস্ট বোলারদের পাশাপাশি আদিল রশিদের মতো লেগ স্পিনার রাখা সেই পরিকল্পনারই অংশ। ব্যাটিং ইউনিটে প্রথম বল থেকে ৩০০তম বলে বড় শট খেলার সামর্থ্যসম্পন্ন বিগ হিটার প্রায় সবাই- অ্যালেক্স হেলস, জেসন রয়, মরগ্যান, বেন স্টোকস, জস বাটলার, জনি বেয়ারস্টো, মঈন আলী, জো রুট।
২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেওয়ার পর ওয়ানডেতে ৩০০-এর অধিক স্কোর করায় সবচেয়ে এগিয়ে ইংল্যান্ড। এই সময়ে তারা ৪৪ বার ৩০০-এর অধিক স্কোর গড়েছে তারা, যার মধ্যে ৩৫টিতেই জয় পেয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ভারত ৩০০-এর অধিক স্কোর ছুঁয়েছে ২৯বার।
বৈচিত্র্য গর্বের ব্যাপার
ইংল্যান্ডের প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের জন্ম আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে। ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার আগে ২০০৭ বিশ্বকাপেও তিনি আইরিশদের হয়ে খেলেছেন। ফাইনালের নায়ক বেন স্টোকসের জন্ম নিউজিল্যান্ডে। বিধ্বংসী ওপেনার জেসন রয়ের জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায়।
ইংল্যান্ডের দুই স্পিনার আদিল রশিদ ও মঈন আলী দুজনেই পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত। সুপার ওভারের নায়ক পেসার জোফরা আর্চারের জন্ম বারবাডোজে। বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র কয়েক মাস আগে তার ইংল্যান্ডের জার্সিতে অভিষেক হয়।
এক যুগ আগে আয়ারল্যান্ড ছেড়ে ইংল্যান্ডের নাগরিকত্ব গ্রহণ করা মরগানকে বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ের উৎসব শেষে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, ‘এটাই কি তবে আইরিশম্যানের ভাগ্য?’
জবাবে মরগান বলেন, ‘আল্লাহ আমাদের সঙ্গে ছিলেন। ’
ইংলিশ অধিনায়কের জবাব শুনে প্রশ্নকর্তার মাথা চুলকানো দেখে মরগান তড়িৎ বিষয়টা খোলাসাও করেন, ‘ম্যাচ চলাকালীন আমি আদিল রশিদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। সে বললো, আল্লাহ অবশ্যই আমাদের সঙ্গে আছেন। ’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দলটি বৈচিত্র্যময়। আমাদের সংস্কৃতি আলাদা। অনেকেই বেড়ে উঠেছে ভিন্ন দেশে। তবু আমরা মাঠে মাথা ঠাণ্ডা রেখে এক জোট হয়ে খেলেছি। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০২০
এমএইচএম