বাংলাদেশের ক্রিকেটে মোহাম্মদ আশরাফুলের নামটা শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেশের প্রতিভাবান ব্যাটম্যানদের মধ্যে অন্যতম তিনি।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখার ২০ বছর হয়ে গেছে তার। তবে তার ক্যারিয়ারের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটা ঘটে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের দায়ে সবধরনের ক্রিকেট থেকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হতে হয় তাকে। পরে তার শাস্তি কমানো হয় দুই বছর। তার ক্রিকেটীয় কারিয়াররে বড় একটা ধাক্কা ছিল এটি।
২০১৭ সালে আবার ক্রিকেটে ফেরেন টেস্ট ক্রিকেটে সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ানের মালিক। তবে জাতীয় দলে ফেরাটা তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। ৭ বছর হলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বাইরে তিনি। তবে জাতীয় দলে খেলার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। কঠোর অনুশীলন করছেন আশরাফুল। ব্যস্ত সময়ের মাঝেই বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হলো আশরাফুলের। অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটার কথা বলেছেন দেশের ক্রিকেট কি পরিবর্তন তিনি দেখেছেন, টেস্ট ক্রিকেটে কেন বাংলাদেশকে এখনো যুদ্ধ করতে হয়, কোন জায়গাতে ঘাটতি রয়েছে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের পরিবর্তন নিয়ে আশরাফুল বলেন, 'পরিবর্তন তো অনেক দেখেছি, আমি ইতিবাচক-নেতিবাচক দুইটাই দেখেছি। যখন আমরা টেস্ট স্ট্যাটাস পেলাম তখন, আর এখন প্রায় ২০ বছরের অভিজ্ঞতা হয়েছে। পরিবর্তন বিশেষ করে আমাদের তো ওয়ানডে টিমটা অসাধারণ পরিবর্তন হয়েছে। আমদের হোম কন্ডিশনে আমরা যে কোনো দলের জন্য শক্তিশালী দল আর টেস্ট ক্রিকেটে আমরা মাঝখানে কিছুটা ভালো করেছিলাম। মুশফিকের অধিনায়কত্বতে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পরযন্ত তিন বছর ভালোই করেছিলাম। সেটা আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। আর টি-টোয়েন্টিতে আরো ভালো করতে হবে। এটাও আমাদের হাতে নেই কারণ খেলাই তো হয় না। ভালো স্পেশালিষ্ট ব্যাটসম্যান দরকার। '
টেস্ট ক্রিকেটে আশরাফুলের অভিজ্ঞতা কম নয়। ৬১ টি টেস্ট খেলেছেন তিনি। যদিও পারফরম্যান্স তেমন উজ্জ্বল নয়। ২৪ গড়ে করেছেন ২ হাজার ৭৩৭ রান। ৬টি সেঞ্চুরি ও ৮টি হাফ-সেঞ্চুরি করেছেন। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে তার পারফরম্যান্স আরও একটু ভালো। ১৬৪টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ২৯ গড়ে করেছেন ৮ হাজার ৩৯৪ রান। রয়েছে ২১টি সেঞ্চুরি ও ৩৫টি হাফ সেঞ্চুরি।
টেস্ট ক্রিকেটে কেন আমরা এতো পিছয়ে আছি এমন প্রশ্নে অভিজ্ঞ আশরাফুল বলেন, 'টেস্ট ক্রিকেটে আমরা ২০ বছরে একশর ওপরে টেস্ট খেললাম। এমনো হয়েছে ১৩-১৪ মাস টেস্ট ক্রিকেট খেলি নাই। অনেক বিরতি দিয়ে টেস্ট খেলেছি আমরা। এই জায়গাতে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের যদি শিডিউল থাকতো যে প্রতি বছরই আমরা নিয়মতি টেস্ট খেলছি তাহলে টেস্টে আরো ভালো করে পারতাম। কারণ ১৩ মাস ১৪ মাসের এমন বড় বড় বিরতি দিয়ে টেস্ট খেললে আবার নতুন করে টেস্ট খেলা শুরু করতে হয়। '
তবে আশরাফুল মনে করেন টেস্টে ভালো করতে হলে সেই মানের বোলার দরকার, যেন প্রতিপক্ষের ২০ উইকেট নেওয়া যায়। আমদের দেশে সেরকম বোলার নেই বলেই টেস্টে আমরা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাচ্ছি না।
আশরাফুল বলেন, 'আমদের আসলে ঐ মানের বোলার তৈরি হয়নি, যে ২০ উইকেট নেওয়ার মতো বোলার। যদি উইকেট সহজ হয় সেক্ষেত্রে ভালো মানের বোলার দরকার হয়। আমদের যেহেতু খেলা কম হয় এজন্য এই সমস্যাটা হচ্ছে। বেশি বেশি খেললে তখন আর এই সমস্যাটা থাকবে না। '
ঘরোয়া ক্রিকেটে উইকেটটা আরো ভালো করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। অবশ্য গত দুই-তিন বছর ধরে ঘরোয়া ক্রিকেটে উইকেটটা বেশ ভালোভাবেই বানানো হচ্ছে। বোলারদের সুবিধা মতোই উইকেট তৈরি করা হচ্ছে। তাই ভালো মানের বোলার পাওয়া নিয়ে কিছুটা হলেও চিন্তা কমবে।
তিনি বলেন, 'ঘরোয়া ক্রিকেটটা আসলে লাস্ট দুই-তিন বছর ধরে বেশ ভালো হচ্ছে। উইকেটগুলোও ভালো দিচ্ছে, উইকেটে ঘাস থাকে। বোলাদের জন্য উইকেট তৈরি করছে। সবচেয়ে বড় কথা চার দিনের ম্যাচ গুলো বেশি বেশি খেলতে হবে। '
টেস্ট ক্রিকেটের জন্য আলাদাভাবে পরিকল্পনা করা উচিত বলে মনে করেন আশরাফুল। ঘনঘন ক্রিকেটারর পরিবর্তন কিংবা অভিষেক করানো ঠিক না। আমদের টেস্ট ক্রিকেটে যেটা বেশি করা হয়। এটা টেস্ট ক্রিকেটের জন্য বেশি মঙ্গলজনক নয়।
আশরাফুল বলেন, 'আপনি যদি দেখেন শেষ ২০ বছরে আমাদের টেস্ট ক্রিকেটারের সংখ্যা হয়ে গেছে ১১০-২০ জন। এমন অনেক ক্রিকেটার আছে যে ২-৩টা টেস্ট খেলে আর খেলতে পারেনি। ২০-৩০ জন এমন ক্রিকেটার আছে যারা দুই-তিনটা টেস্টে খেলার পর আর খেলেনি, এটা তো ক্রিকেটারদের জন্য ভালো না। কি কারণে দলে নিলেন আবার কি কারণে বাদ দিলেন সেটাই পরিস্কার না। এই দিক দিয়ে আমাদের পরিকল্পনাটা আরাও ভালোভাবে করা উচিত। ঘরোয়া ক্রিকেট বেশি খেলে যদি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসা যায় তবে সেটা ক্রিকেটারদের জন্য বেশি ভালো। '
আশরাফুল মনে করেন ক্রিকেটারদের ভালো সময় খারপ সময় আসবেই। খারাপ সময়গুলোতে ক্রিকেটারদের পাশে থাকা প্রয়োজন। ক্রিকেটারদের সময় না দিলে তাদের কাছ থেকে ভালো পারফরম্যান্স বের করে নিয়ে আসা কঠিন হবে।
৩৬ বছর বয়সী এই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার বলেন, 'এটাতে ভাগ্য লাগে আবার সময়ও দিতে হয়। যেমন লিটনের কথা বলি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শুরুটা ভালো হয়নি। তবে ধীরে ধীরে কিন্তু নিজেকে আবার প্রমাণ করেছ সে। একজন ক্রিকেটারকে সুযোগ দিলে তাকে সময়ও দিতে হবে। লিটনকে সেই সময়টা দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে প্রতিভা আছে তাকে সুযোগ দিতে হবে। সময় না দিলে ভালো ক্রিকেটার বের হয়ে আসবে না। '
বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখনো মোহাম্মদ আশরাফুলের ভক্ত রয়েছে অনেক। বাংলাদেশে ক্রিকেটে এমন কিছু ইনিংস খেলেছেন যার জন্য তাকে মনে রাখবে অনেক দিন। কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেঞ্চুরি কিংবা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে রেকর্ড গড়া সেঞ্চুরি হোক তাকে মনে রাখতে হবে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে কিভাবে বিদায় জানবেন সেটাই হয়তো দেখা অপেক্ষায় হাজারো আশরাফুল ভক্ত।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২০
আরএআর/এমএমএস