চট্টগ্রাম: চারুকলা ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিতে সৃষ্ট আন্দোলনে টানা ৬৪ দিন ধরে বন্ধ শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষার্থীরা মূল ক্যাম্পাসে ফিরতে চাইলেও শিক্ষকদের অনীহায় মিলছে না সুরাহা।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি, বেশ কয়েকবার আলোচনা হলেও প্রক্রিয়াগত যেসব কাজ রয়েছে তা শেষ করার সময় দিচ্ছে না শিক্ষার্থীরা।
ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, গত নভেম্বর থেকে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। ফটকে তালা, সড়ক অবরোধ, ক্লাস বর্জন, মানববন্ধন সহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সমাধান না আসায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ এ ইনস্টিটিউট।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তিন মাস ধরে আন্দোলন চললেও সমাধান দিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নতুন বছরের চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা থাকলেও এখনও আসেনি কোনও সিদ্ধান্ত।
শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের স্বার্থে ও এ ইনস্টিটিউটের কয়েকজন শিক্ষকের স্বার্থে এখানে ফেলে রেখেছে তাদের। কয়েকজন শিক্ষক চান না এ ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাসে ফিরুক। তাঁদের বিভিন্ন সুবিধার জন্য এখানেই রয়ে যেতে চান। তাছাড়া চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্রাবাস ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গার ওপর। যদি আমরা এখানে থাকি তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় জায়গাটি দখলে রাখতে পারবে। আমরা চাই না কারও উদ্দেশ্য হাসিলে হাতিয়ার হতে।
এদিকে, চারুকলা ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গঠন করেছে সমন্বয়ক কমিটি। যা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে।
কমিটির সদস্য সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয় সহকারী প্রক্টর মোহাম্মদ ইয়াকুব বাংলানিউজকে বলেন, আমরা কাজ শুরু করেছি। কিন্তু আমাদেরকে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। যদি শিক্ষার্থীরা আমাদের সহযোগিতা না করে তাহলে আমরা কিভাবে এ সমস্যার সমাধান করবো? শিক্ষার্থীরাও জানে এ প্রক্রিয়াটি জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। এভাবে একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকতে পারে না। আমরা যেহেতু প্রক্রিয়া শুরু করেছি, তার বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের উচিত ক্লাসরুমে ফিরে যাওয়া। কারণ সবকিছুর শেষে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
চারুকলা ইনস্টিটিউটকে ক্যাম্পাসে ফেরানোর বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূইঁয়া বাংলানিউজকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে একটি কমিটি৷ কমিটি যাচাই-বাছাই শেষে একটি সিদ্ধান্ত দেবে। বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান চায় কর্তৃপক্ষও। তবে আমাদের একটু সময় দিতে হবে। যেহেতু আইনি বিষয় রয়েছে, তাই বিশ্ববিদ্যালয় সবকিছু যাচাই করেই ব্যবস্থা নিবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল মনসুর এর মতে, চারুকলা বা সৃজননির্ভর বিষয়ের শিক্ষাব্যবস্থা সাধারণ জ্ঞাননির্ভর শিক্ষার চেয়ে অনেকটাই ভিন্নতর। এর জন্য দরকার সৃজনের সাধনার নিভৃতি আর সার্বক্ষণিক অনুশীলনের সুযোগ। অন্যান্য দেশের শিল্প শিক্ষালয়গুলোর দিকে তাকালেও আমরা দেখি, যে শিক্ষালয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয় বা বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের অংশ, সেগুলোও স্বতন্ত্র ক্যাম্পাসে অবস্থিত। সৃজনশীলতার শিক্ষা ভিন্নতর বলেই এটি করা হয়। বর্তমান ইনস্টিটিউটে সৃজনশীল বিষয়ে শিক্ষার যেটুকু সুবিধা রয়েছে, মূল ক্যাম্পাসে গেলে সেটি বাড়বে বলে মনে করার বাস্তব কারণ নেই। আশা করি আন্দোলনকারীরা এটিও মাথায় রাখবেন।
তিনি আরও বলেন, চারুকলার বর্তমান জমিটির দিকে স্বার্থান্বেষী মহলের শ্যেনদৃষ্টি বরাবরই রয়েছে। আজ অর্থবল, বাহুবল, রাজনৈতিক ও সামাজিক অপশক্তির মিলিত দাপটে বিশেষ করে জমি বেদখল হওয়ার তৎপরতা অনেকাংশে বেড়ে গেছে। একটি অধরা মরীচিকার পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা যেন চারুকলার জন্য নির্দিষ্ট মনোরম স্থানটি নিয়ে দখলদারদের সক্রিয় হওয়ার সুযোগ করে না দিই। এ ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ এবং চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজকে একীভূত করে একটি ইনস্টিটিউট তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পরে বিভাগের অ্যাকাডেমিক কমিটি, পরিকল্পনা কমিটি ও অনুষদ কমিটি একত্রিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল ব্যতিরেকে একটি সিন্ডিকেট গঠন এবং চারুকলা বিভাগকে ইন্সটিটিউটে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৯৯৯ সালের ১১ মার্চ চারুকলা বিভাগ ও চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজকে একীভূত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘চারুকলা ইন্সটিটিউট’ ঘোষণা দিয়ে একটি গেজেট প্রকাশিত হয়। এই গেজেট প্রকাশের পর তৎকালীন চারুকলা বিভাগের শিক্ষক ও স্থপতি সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গৃহীত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। যদিও ২০০২ সালে পিটিশনটি খারিজ হয়ে যায়। পরবর্তীতে আইনগত সমস্যা এবং বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আপত্তি প্রকাশের কারণে প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইন্সটিটিউট নির্মাণের এই প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ সময় ধরে স্থগিত রাখা হয়। ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ৪৬২তম সিন্ডিকেট সভায় ৮৬ নম্বর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চারুকলা বিভাগ এবং চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজকে একীভূত করার মধ্যদিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
২০১০ সালের ২ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে প্রেরিত এক চিঠিতে চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজের অস্থাবর সকল সম্পদ ডিউ অব গিফটের আওতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের মাধ্যমে একে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে একীভূত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন চারুকলা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই চিঠির প্রেক্ষিতে ২০১১ সালে নগরীর মেহেদিবাগের বাসিন্দা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজকে আত্মীকরণ এবং প্রতিষ্ঠানের সকল সম্পত্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক হস্তান্তর সম্পূর্ণ অবৈধ উল্লেখ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট ডিভিশনে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। উচ্চ আদালত এই রায় স্থগিত রাখেন।
তবে এই স্থগিত আদেশ বলবৎ থাকাকালীন সময়ে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চারুকলা কলেজকে আত্মীকরণ করে চারুকলা বিভাগকে বাদশা মিয়া সড়কে স্থানান্তরিত করে। একই বছর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে আলাদা হয়ে এ ইনস্টিটিউট কার্যপরিচালনা শুরু করে। শিল্পী মোহাম্মদ জসিম উদ্দিনকে পরিচালক নিযুক্ত করে নতুনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নগরীর বাদশাহ মিয়া চৌধুরী সড়কে বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউটের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০২৩
এমআর/টিসি