চট্টগ্রাম: আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে আরামদায়ক, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ যোগাযোগ মাধ্যমের নাম রেলব্যবস্থা। বাংলাদেশেও যোগাযোগ ব্যবস্থায় সড়কপথের তুলনায় রেলপথে ভ্রমণ করা নিরাপদ এবং আরামদায়ক।
ট্রেনে ভ্রমণ করতে কষ্ট যেমন কম, তেমনি খরচও সাধ্যের মধ্যে। তাই মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তরাও ট্রেন ভ্রমণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য মতে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে বর্তমানে ৫৮টি আন্তঃনগর এবং কমিউটার ও মেইল ট্রেনসহ ৬০টি ট্রেন চলাচল করে। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে সারাদেশে ৮টি কন্টেনার ট্রেন এবং ১৯টি গুডস ট্রেন চলাচল করে। লোকাল ও ডেমু ট্রেন মিলিয়ে ৩৭টি ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে মোট ১২০টি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ৫৮টি এবং পশ্চিমাঞ্চলে ৬২টি। কমিউটার ও মেইল ট্রেন চলাচল করে ১২৮টি। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ৬০টি এবং পশ্চিমাঞ্চলে চলে ৬৮টি। এছাড়া সারাদেশে আটটি কনটেইনার ট্রেন এবং ১৯টি গুডস ট্রেন চলাচল করে। সব মিলিয়ে বর্তমানে চালু আছে ২৭৫টি ট্রেন।
পূর্বাঞ্চলে বন্ধ থাকা ট্রেনের হিসাবে দেখা যায়, লোকাল ও ডেমু ট্রেন মিলিয়ে পূর্বাঞ্চলে ৩৬টি এবং লোকাল ও মিশ্র মিলিয়ে ৩৭টি ট্রেন বন্ধ আছে। পূর্বাঞ্চলে বন্ধ থাকা ময়মনসিংহ-দেওয়ানগঞ্জ বাজার-ময়মনসিংহ রুটে চলাচলকারী লোকাল ২৫১/২৫২ ট্রেন, ময়মনসিংহ-ভৈরব বাজার-ময়মনসিংহ রুটের লোকাল ২৪১/২৪২, ৩৪৫/৩৪৬ ট্রেন, সিলেট-ছাতকবাজার-সিলেট রুটের লোকাল ৩৪১/৩৪২ এবং ৩৪৫/৩৪৬ ট্রেন ২০২০ সালের ২৪ মার্চ, চট্টগ্রাম-সিলেট-চট্টগ্রাম রুটের জালালাবাগ এক্সপ্রেস ১৩/১৪ ট্রেন ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর, চট্টগ্রাম-দোহাজারী-চট্টগ্রাম রুটের দোহাজারী কমিউটার ১/৬ ট্রেন ২০২৩ সালের ১ আগস্ট, এসব ট্রেন ইঞ্জিন, ক্রু ও কোচ সংকটে বন্ধ হয়ে যায়।
এছাড়া চট্টগ্রাম-নাজিরহাট-চট্টগ্রাম রুটের নাজিরহাট কমিউটার ১/৬ ট্রেন ২০২৩ সালের ৮ ডিসেম্বর, চট্টগ্রাম-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-চট্টগ্রাম রুটের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কমিউটার ১/২/৩/৪ ট্রেন, লাকসাম-চাঁদপুর-লাকসাম রুটের চাঁদপুর কমিউটার ৮১/৮২ ট্রেন, লাকসাম-নোয়াখালী-লাকসাম রুটের নোয়াখালী কমিউটার ৮৫/৮৮ ট্রেন ২০২০ সালের ২৪ মার্চ, চট্টগ্রাম-পটিয়া-চট্টগ্রাম রুটের পটিয়া কমিউটার ১/২ ট্রেন ২০২৩ সালের ৮ ডিসেম্বর বন্ধ হয়ে যায়। এসব ট্রেন বন্ধ হাওয়ার কারণ হিসেবে ‘এমসি আন্ডার রিপেয়ার’ থাকার কথা বলা হয়েছে।
পূর্বাঞ্চলের ঢাকা-যমুনা সেতু পূর্ব-ঢাকা রুটে টাঙ্গাইল কমিউটার ১০৭/১০৮ ট্রেন ২০২৪ সালের ৪ মে, ময়মনসিংহ ভুয়াপুর-ময়মনসিংহ রুটের ধলেশ্বরী কমিউটার ৭৫/৭৬ ট্রেন ২০২৪ সালের ২৮ মে বন্ধ হয়ে যায়। এই দুটি ট্রেন বন্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে ইঞ্জিন স্বল্পতার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, রেলের ইঞ্জিন আমাদের দেশে উৎপাদন হয় না, বিদেশ থেকে আনতে হয়। টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অর্ডার দিলে ইঞ্জিন পেতে মিনিমাম দুই থেকে তিন বছর সময় লাগে।
তিনি বলেন, মিটারগেজ ও ব্রডগেজ মিলে আমাদের এখন ৯০টির মতো ইঞ্জিন প্রয়োজন। নতুন ইঞ্জিন কেনার জন্য পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। প্রথম ধাপে এডিবির অর্থায়নে মিটারগেজের জন্য ৩০টি ইঞ্জিন কেনার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে বর্তমানে ১৪০টি ইঞ্জিন আছে। এর মধ্যে ২০ বছরের পুরোনো রয়েছে ৮২টি। রেলের ইঞ্জিনের অর্থনৈতিক আয়ুস্কাল ধরা হয় ২০ বছর। ২০ বছরের কম, এ রকম ইঞ্জিন আছে ৫৮টি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে রেল খাতে কোটি টাকা ব্যয় হয়। বিশেষ করে রেলপথ নির্মাণ ও দৃষ্টিনন্দন স্টেশন নির্মাণে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। তবে ইঞ্জিন ও কোচের সংকটে নিরসনে মনোযোগ ছিল কম। শেষ ১২ বছরে মাত্র ৩৯টি ইঞ্জিন কেনা হয়েছিল। যার মধ্যে সর্বশেষ ২০২১ সালে কেনা হয় ২৯টি ইঞ্জিন। যেগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
রেলওয়ের যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে প্রতিদিন ১১৩ থেকে ১১৬টি ইঞ্জিন প্রয়োজন। কাগজে-কলমে ১৪০টি ইঞ্জিন থাকলেও পাওয়া যায় ৮০ থেকে ৮২টি। একটি ইঞ্জিন গন্তব্যে পৌঁছার পর কিছু সময়ের জন্য বিশ্রামে রাখতে হয়। কিন্তু তা সম্ভব হয় না। ফলে মাঝপথে ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ মো. সামছুল হক জানান, রেলে সেবার মান ও যাত্রী পরিবহনের সংখ্যা একেবারেই বাড়েনি। অর্থ ব্যয়, বিনিয়োগ সুবিবেচনাপ্রসূত হয়নি। ইঞ্জিন-কোচ সংগ্রহ করার চেয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নে নজর ছিল রেলের। প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা ও ব্যয় হয়েছে বেশি। যার খেসারত দিচ্ছেন যাত্রীরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২৫
বিই/টিসি