ঢাকা, শনিবার, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ মে ২০২৪, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

পাহাড়ি তরুণ-তরুণীদের স্বপ্নের ঠিকানা ‘বিটিটিসি’

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৫
পাহাড়ি তরুণ-তরুণীদের স্বপ্নের ঠিকানা ‘বিটিটিসি’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বান্দরবান ঘুরে এসে: বান্দরবানের রুমা উপজেলার ঠান্ডাঝিরি পাড়ার যুবক ক্যা মু উ (২৫)। বুঝতে শেখার আগেই মা হারান, বাবা মার যান ২০০৮ সালে।

এতিম ক্যা মুকে খাওয়াতে, পরাতে হবে এ আশংকায় কেউ তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখত না। নি:স্ব ক্যা মু একদিন এসে পড়ে বান্দরবান টেকিনক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে (বিটিটিসি)।
আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। কার্পেন্ট্রির কাজ শিখে ক্যা মু এখন সেখানেই কর্মরত। সেদিনের নি:স্ব ক্যা মু’র এখন ব্যাংকে টাকাও জমা আছে।

রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ঢেবাছড়ি গ্রামের কাজল তঞ্চঙ্গ্যা (২০)। কাজ শেখার স্বপ্ন নিয়ে গত ২ জানুয়ারি কাজল বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে। জীবনে কোনদিন বাস চোখে না দেখা কাজল পায়ে হেঁটে, নদী পার হয়ে ২৪ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে পরদিন চলে আসেন বিটিটিসিতে। ভর্তি হয়েছেন ইলেকট্রিক্যাল কোর্সে। তার চোখে এখন অনেক স্বপ্ন, কাজ শিখবে, চাকুরি করবে, বদলে দেবে পাহাড়ের কষ্টের জীবন।

পাহাড়ের বাসিন্দা, জীবন বয়ে নিতে যাদের দুর্ভোগের অন্ত নেই, কথিত শহুরে নাগরিক সভ্যতার কাছে যারা এখনও বেমানান, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মৌলিক অধিকার যাদের কাছ থেকে এখনও যোজন যোজন দূরে তাদের কাছে বিটিটিসি স্বপ্নের মত। দশকের পর দশক ধরে ক্যা মু উ, কাজল তঞ্চঙ্গ্যাদের মত তরুণ-তরুণীদের স্বপ্নের পথে হাঁটতে শেখাচ্ছে বিটিটিসি।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ির তরুণ-তরুণীদের এ স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছে তাদের পরিচালিত বিটিটিসি’র মাধ্যমে। বান্দরবান সদরের উজানীপাড়ায় এ ট্রেনিং সেন্টারটির অবস্থান।

কারিতাস’র আঞ্চলিক পরিচালক জেমস গোমেজ বাংলানিউজকে জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের পিছিয়ে পড়া আদিবাসি জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অথনৈতিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করে ‘তাঁত  ও কার্পেন্ট্রি ট্রেড‘ নিয়ে ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রয়াত ফাদার নেলসন বাট্রাম সিএসসি’র হাত দিয়ে এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু।

১৯৭৭ সালে ফাদার নেলসনের অনুরোধে কারিতাস এর পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। ১৯৮৫ সাল থেকে তাঁত ট্রেড বন্ধ করে ইলেকট্রিক্যাল ট্রেড কোর্স চালুর মধ্য দিয়ে বৃহত্তর পরিসরে এর যাত্রা শুরু হয়।

বিটিটিসি’র অধ্যক্ষ রাখাল দাশ বাংলানিউজকে জানান, সাতটি ট্রেডে বর্তমানে বিটিটিসি প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এগুলো হচ্ছে, কার্পেন্ট্রি, ইলেকট্রিক্যাল ট্রেড, সেলাই, ইঞ্জিন মেকানিক, হাঁস মুরগী ও গবাদী পশু পালন, মোবাইল ফোন মেরামত এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণ। একসময় ওয়েল্ডিং কোর্স থাকলেও বর্তমানে সেটি বন্ধ আছে।

তিন মাস থেকে এক বছর মেয়াদি এসব কোর্সে যারা ভর্তি হন তাদের জন্য থাকা এবং দুই বেলা ভাতের ব্যবস্থা আছে। আবার প্রশিক্ষণ শেষে বিটিটিসি’র প্রোডাকশন সেলে কাজেরও সুযোগ আছে। আর বিটিটিসি’র সনদ থাকলে বাইরেও কাজের সুযোগ প্রচুর বলে জানান রাখাল দাশ।

কারিতাসের দেয়া তথ্যমতে, কারিতাস দায়িত্ব নেয়ার পর সুইজারল্যান্ড এ প্রকল্পে অর্থায়ন করত। ২০০৯ সালের জুন মাস থেকে সুইজারল্যান্ড অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়।

রাখাল দাশ বাংলানিউজকে বলেন, আমরা এখন নিজেদের আয়ে চলি। আমাদের ফার্ণিচার ও গ্রীল ওয়ার্কশপে বছরে ২১ থেকে ২২ লক্ষ টাকার কাজ হয়। কিছু ঘরভাড়া পাই, টিউশন ফিও আসে।

কারিতাস’র কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ‍জানা গেছে, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল থেকে যেসব তরুণ-তরুণীরা বিটিটিসিতে আসেন তারা কেউই বাংলা বলতে কিংবা বুঝতে পারেন না। এজন্য প্রফেশনাল ট্রেড কোর্সের বাইরে আধা ঘণ্টা ধরে বাংলা ভাষার উপর ক্লাশ নিতে হয়।

পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় কারিতাস’র যেসব প্রকল্পের কার্যক্রম চলছে সেখানে কর্মরতরাই মূলত বিটিটিসি’র কথা প্রচার করেন। এভাবে দুর্গম এলাকার পাহাড়ি জনসাধারণ জেনে যাচ্ছেন বিটিটিসি’র নাম।

২০০৮ সালে কারিতাস’র নির্বাহি পরিচালক ড.বেনডিক্ট আলো ডি রোজারিও বান্দরবানের রুমা উপজেলার ঠান্ডাঝিরি গ্রামে একটি প্রকল্পের উদ্বোধন করতে যান। সেখানে এতিম বালক ক্যা মু উ এসে উপস্থিত হন। গ্রামের লোকজনের মুখে তার অসহায়ত্বের কথা শুনে বেনডিক্ট নিজেই ক্যা মুকে নিয়ে আসেন বিটিটিসিতে।

ক্যা মু উ বাংলানিউজকে বলেন, এখানে থেকে আমি কাজ শিখেছি। এখন আমি ৪৫০০টাকা বেতনে এখানে চাকরি করছি। আগে কেউ আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি। এখন গ্রামের লোকজন আমার খোঁজখবর নেন। আমি ব্যাংকে টাকা জমাই। ২০ হাজার টাকা দিয়ে গ্রামে বাগান কিনেছি। সেখানে ৩০টি রাবার গাছ আছে।

কারিতাসের দেয়া তথ্যমতে, বিটিটিসি থেকে এ পর্যন্ত ২ হাজার ১৮৩ জন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এদের মধ্যে প্রায় ৮৮ ভাগ শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থান হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২,২০১৫/আপডেট : ১০২৯ ঘণ্টা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।