দোহাজারী থেকে ফিরে: শীতের ভোর। কুয়াশার দাপটটা এতই তীব্র-খোলা চোখে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে কি আছে-তাও দেখা প্রায় অসম্ভব।
আসছে সারি সারি নৌকা। কোনটা ভর্তি ফুলকপিতে, কোনটা মুলায়, আবার কোন কোনটা বেগুনে ঠাসা। নৌকাগুলোর গন্তব্য, দোহাজারী রেলওয়ে মাঠের ঘাঁট। সেই ঘাঁটের অদূরেই দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় সবজির হাট বলে খ্যাত ‘দোহাজারী সবজি বাজার’। চন্দনাইশ উপজেলার দক্ষিণ সীমান্তে এই বাজারের অবস্থান।
প্রতিদিন ভোর ছয়টা থেকেই কৃষকরা সবজি নিয়ে আসেন এ বাজারে। ফুলকপি থেকে বাধাকপি, মুলা, আলু, বেগুন, বরবটি, পটল, শিম, শশা, লাউ, ঝিঙা, চিচিংগা, ঢেড়ষ, মিষ্টি কুমরা, টমেটো, করলা কিংবা কাকরল, সঙ্গে বিভিন্ন রকমের শাক-কী নেই এই বাজারে।
ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত এই হাটে সবজির মেলা বসে। সবজির পসরা সাজিয়ে বিক্রেতারা বসেন এখানে। চট্টগ্রাম নগরীসহ বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ক্রেতারা এখান থেকে সবজি নিয়ে ফেরেন নিজ নিজ গন্তব্যে। প্রতিদিনিই ১০০ থেকে ১৫০ পিকআপ সবজি বিক্রি হয় এই বাজারে।
বুধবার (২০ ডিসেম্বর) ভোর ছয়টায় সরেজমিনে সাংগু নদীর উত্তরপাড়ে গিয়ে দেখা গেছে, হাজারীবাজার, বারতখানা, চাগাচর, জামিরজুরী, লালটিয়া, দিয়াকুল, রায়জোয়ারা, কিল্লাপাড়া, লালিয়ার চর সহ নানা এলাকায় সবজির চাষ হচ্ছে। সাংগু নদীর পানি দিয়েই বছরভর সবজি চাষ হয় এসব জায়গায়।
লালিয়ার চরে কথা হয় কৃষক আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি ফুলকপি-বাধাকপি-মুলা চাষ করেছেন। এই কৃষক জানান, তিনি এবার চার কানি জমিতে ফুলকপি, বাধাকপি ও মুলা চাষ করেছেন। দুই সপ্তাহ আগে দাম বেশি পেলেও এখন কিছুটা কমে গেছে। তার জমিতে উৎপাদন হওয়া ফুলকপি বাধাকপি আর মুলা বিক্রি প্রায় শেষের দিকে।
তিনি বলেন, এক কানি জমিতে ৭ হাজার ফুলকপির বিজ রোপন করেছিলাম। ফুলকপি চাষ করতে গিয়ে কীটনাশক, সার আর শ্রমিকদের বেতনসহ সবমিলিয়ে ১০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছিল। ফুলকপি বিক্রি করে এই মৌসুমে আয় হয়েছে প্রায় এক লাখ টাকা।
অন্যান্য সবজিগুলো বিক্রি করেও ঠিক একইভাবে লাভবান হয়েছেন আনোয়ার হোসেন নামে এই কৃষক।
সকাল সাতটার দিকে দোহাজারী বাজার ঘুরে দেখা যায়, দুই ঝুড়ি করে সবজি বিক্রি করছেন কৃষকরা। মাপজোকের ঝামেলা নেই। আনুমানিক হিসেবেই (টিকায়) বিক্রি হচ্ছে এসব সবজি। দেখা গেছে, দুই ঝুড়ি মুলা বিক্রি হচ্ছে এক হাজার টাকায়, ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ১৬০০ টাকায়, বাধাকপি ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকায়। একইভাবে অন্যান্য সবজিগুলোও বিক্রি হচ্ছে।
কৃষকদের দাবি প্রতি দুই ঝুড়িতে মুলা আছে প্রায় ১০০ কেজি, ফুলকপি ও বাধাকপি আছে প্রায় ৮০ কেজি করে।
সবজি বাজারে কথা হয় কৃষক দিদারুল আলমের সঙ্গে। তিনি চাগাচরে উৎপাদিত ফুলকপি নিয়ে এসেছেন বাজারে। তিন পুরুষ ধরে এই সবজি চাষ করে যাচ্ছেন দিদারুল আলমরা।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘আমার দাদাও সবজি চাষ করতেন, বাবাও করতেন। দাদা আর বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা ভাইরাও সবজি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করছি। ’
প্রতিদিনই এই বাজারে প্রায় ২০ লাখ টাকার মতো সবজি বিকিকিনি হয় বলে জানিয়েছেন সবজি ক্রেতা আর বিক্রেতারা।
বাংলাদেশ কৃষক সমিতির স্থানীয় শাখার প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ ওসমানের সঙ্গে কথা হয় সবজি বাজারে।
এই কৃষক নেতা বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ এলাকার প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের খাবারের যোগান আসে সবজি বিক্রির টাকা থেকেই। নদী পাড়ের কয়েক হাজার মানুষের সবজি চাষই মূল পেশা। নগরীসহ বিভিন্ন এলাকার সবজির যোগান দেন এই এলাকার কৃষকরা। তবে আমরা সেই হিসেবে তেমন সুযোগ সুবিধা পাই না। দরদামও তেমন পাচ্ছি না-সবজি সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারণে। এসব সমস্যার সমাধান হলে কৃষকরা চাষাবাদে আরও আগ্রহী হবেন। আমাদের দিকে প্রশাসন নজর দিলে আমরা পুরো নগরীর সবজির যোগান দিতে পারবো বলে আশা করি। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৬
টিএইচ/আইএসএ/টিসি