সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম) থেকে ফিরে: শিশির ভেজা শিমের ক্ষেত। লকলকে শিমের ডগায়, সাদা-লাল ফুলের পাপড়িতে চিকচিক করছে শিশির বিন্দু।
উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র নাথ বাংলানিউজকে জানালেন, এবার সীতাকুণ্ডে ২ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে শিমের আবাদ হয়েছে। বাটা, পুঁটি, ছুরি, কাত্তিকোটা ইত্যাদি স্থানীয় জাতের শিম লাগিয়েছেন চাষিরা। আশা করা হচ্ছে, প্রতি হেক্টরে ৩০ টন করে প্রায় ৮৪ হাজার টন শিম উৎপাদন হবে।
একসময় ধানের ব্যবসা করতেন আছিরাম দাশ (৬২)। এখন শিম চাষ করেই সংসার চালান তিনি। বললেন, দুই জাতের শিমই বেশি হয় সীতাকুণ্ডে। ‘কাত্তি কোটা’ আর ‘ছুরি’। একটি লাল, অন্যটি সবুজ-সাদা লম্বাটে। সৃষ্টিকর্তার বিশেষ নজর আছে বলেই সীতাকুণ্ডের শিম দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এখানকার মাটি শিম চাষের জন্য খুবই উপযোগী।
শেখনগর (শেখ পাড়া) এলাকার আবু বকর সিদ্দিকী (৮০) বংশ পরম্পরায় শিম চাষ করে আসছেন। তার চার ছেলেও শিম চাষে সাহায্য করেন। বললেন, ছয় গণ্ড (৪৮ শতক) জমিতে ছুরি শিম লাগিয়েছেন তিনি। প্রথম দিকে সবজি হিসেবে শিম বিক্রি করবেন। এরপর শিমের সরবরাহ বেশি হয়ে গেলে বিচি বের করে আলাদা বিক্রি করবেন। শিম চাষে অন্যান্য সবজির মতো পানি সেচ দিতে হয় না। শুধু প্রতিটা শিমগাছে তিনটি করে ৫ টাকা দামের বাঁশের খুঁটি দিতে হয়। তবে পোকামাকড়ের উপদ্রব দেখা দিলে ওষুধ ছিটাতে হয়।
দুবাইফেরত বাবলু মিয়া (২৮) শিম চাষ করে ভাগ্য বদল করেছেন। তিনি দেড় লাখ টাকা খরচ করেছেন শিম ক্ষেতে। যেভাবে ফুল-কড়া আসছে তার আশা এবার ভালো লাভ করতে পারবেন।
তিনি বলেন, বর্গা জমিতে প্রতি কড়ায় চৈত্র মাস থেকে পরবর্তী চৈত্র মাস পর্যন্ত এক বছরের খাজনা দিতে হয় ৩০০-৪০০ টাকায়। সীতাকুণ্ডে প্রায় সব ধরনের সবজি হয়ে থাকে। কিন্তু সেচ ও পরিচর্যা খাতে কম ব্যয়ের কারণে চাষিরা শিম চাষেই বেশি আগ্রহী।
পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় আবুল মনসুর (৭০) শিম ক্ষেতে স্প্রে করছিলেন পোকামাকড়ের ওষুধ। বললেন, ওষুধ কাজ করে না তাই পোকামাকড়ের উৎপাত লেগেই আছে। ফুল আসার মৌসুমে পোকা, শুভ লক্ষণ নয়।
আবুল মনসুরও বিদেশফেরত। দুবাইতে ভালো একটি কোম্পানিতে কাজ করতেন। পাসপোর্টে ৬০ বছর বয়স হওয়ায় দেশে চলে আসতে হয়েছে। এরপর থেকে কৃষিকাজ করে বিশেষ করে শিম চাষেই হাসি ফুটিয়েছেন সংসারে।
মো. মানিকেরও (৫৫) ঠোঁটের কোণে খেলা করছে হাসি। লকলক করছে বড় হচ্ছে শিমের চারা। বললেন, শিমের ক্ষেতে লতা এত বেশি জড়িয়েছে হাঁটাও যাচ্ছে না। মাটিতেও বেড়ে উঠছে গাছ। বাঁশের কঞ্চির দাম বেশি (মঙ্গা)। তাই বিভিন্ন ধরনের গাছের ডালপালা দিচ্ছেন শিম গাছে।
ইদিলপুরের মেয়ে দিলুয়ারা বেগম (৬০)। বললেন, ছোটবেলায় শিম লাগানো হতো ভিটেবাড়িতে। জমিতে হতো ধান। এখন চাহিদা বেড়েছে, ফলন বেড়েছে তাই জমি, ভিটা, কবরস্থান, রাস্তা, খাল কিছুই বাদ নেই। শিমের নানা পদ ঘরে ঘরে জনপ্রিয়। বিশেষ করে ভর্তা, সবজি, ভাজি, খাইস্যা (বিচি), ডাল, শুকনো বিচি পোড়া ইত্যাদি। চাহিদা বেশি হওয়ায় যেখানেই সুযোগ মিলছে শিম লাগাচ্ছেন সবাই। সমস্যা হচ্ছে, যত বেশি চাষাবাদ হচ্ছে শিমগাছে আসছে নতুন নতুন রোগব্যাধিও। অনেক সময় ওষুধেও কাজ করছে না।
ওষুধে কাজ না করার অভিযোগ প্রসঙ্গে ওয়াপদা গেটের সার-কীটনাশক বিক্রেতা মেসার্স রিজভী ট্রেডার্সের মালিক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, অনেক নিম্নমানের ও নকল ওষুধে বাজার সয়লাব হয়েছে এটা যেমন সত্য, তেমনি চাষিদের সঠিক মাত্রাজ্ঞান না থাকার কারণেই ওষুধ কাজ করছে না এটাও সত্য। আবার অনেক সময় একটি ওষুধ প্রয়োগের পর নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা না করে আরেকটি ওষুধ প্রয়োগের ঘটনাও আছে। আমরা উপজেলা কৃষি বিভাগে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়ে থাকি।
সীতাকুণ্ড বাজারে খুচরা সবজি বিক্রি করছেন মো. বেলাল হোসেন। বললেন, এখনো শিম তোলার মৌসুম পুরোপুরি শুরু হয়নি। এখন সীতাকুণ্ডের ছুরি শিম ও কাত্তি কোটা ৬০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আবার হাইব্রিড রূপবান শিম ৪০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ১৫-২০ দিনের মধ্যে শিমের দাম কমে যাবে। প্রায় সব ক্ষেতেই শিম তোলা হবে। গত বছর সর্বনিম্ন ১০-১২ টাকাও বিক্রি করেছি শিম।
সীতাকুণ্ড সবজি ভাণ্ডার নামের আড়তের ম্যানেজার সুজিত পাল বাংলানিউজকে বলেন, শিমের রাজ্য সীতাকুণ্ড। এখানকার শিমের রং, রূপ আর স্বাদই আলাদা। দেশজুড়ে আলাদা কদর রয়েছে এখানকার শিমের। রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও।
মুরাদপুর এলাকার চাষি আবু তাহের বাংলানিউজকে বলেন, বেড়িবাঁধ এলাকায় ছুরি শিমের ফলন ভালো হয়েছে এবার। আগামী শুক্রবার থেকে হাটে শিম বিক্রির জন্য নিয়ে যাবো।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৬
এআর/আইএসএ/টিসি