চট্টগ্রাম: ৪০ বছর ধরেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই তার বাস। এই ক্যাম্পাসেই তার সন্তানদের বেড়ে ওঠা।
ছেলের চলে যাওয়ার একমাস পূর্ণ হলো মঙ্গলবার (২০ ডিসেম্বর)। তার আগেই শোকাস্তব্দ এই মা অন্য সন্তানদের নিয়ে সেই ‘অভিশপ্ত’ ঘরটি ছেড়ে দিয়েছেন। সেখানে যে আর রাত কাটাতে পারেন না তিনি। ছেলের মরদেহ ঝুলে থাকার দৃশ্যটা যে বারবার তাড়িয়ে বেড়ায় মাকে।
তাই চলতি মাসের শুরুর দিকে এই বাসাটি ছেড়ে দিয়াজের ভাই-বোনরা উঠেছেন নগরীতে অবস্থিত বড় বোনের বাসায়। অন্যদিকে পাগলপ্রায় মা জাহেদা আমিন চৌধুরীর দিন কাটছে কখনও ক্যাম্পাসে অবস্থিত বাপের বাসায়, কখনও আবার নগরীর বড় মেয়ের বাসায়।
পরিবার সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল হলের পেছনে অবস্থিত শাহী কলোনিতে ১৯৮৩ সাল থেকেই থাকছিল দিয়াজের পরিবার। তবে মা-বাবার চাকরি সূত্রে অবশ্য জাহেদা আমিন চৌধুরী ক্যাম্পাসে বাস করে আসছেন আরও আগ থেকেই। তার বড় মেয়ে ছাড়া দিয়াজ ইরফান চৌধুরী সহ অন্য চার সন্তানের জন্ম এই ক্যাম্পাসেই। পরবর্তীতে তিনি ২০০৯ সাল থেকে ক্যাম্পাসে দুই নম্বর গেট এলাকায় ভাড়া বাসায় উঠেন সন্তানদের নিয়ে। এই বাসা থেকেই ২০ নভেম্বর রাতে দিয়াজের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
ওই দিন রাতেই দিয়াজের মরদেহ উদ্ধার শেষে ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। পরে ২৩ নভেম্বর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে দিয়াজের মৃত্যু আত্মহত্যাজনিত কারণে বলে মত দেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা। তবে এই প্রতিবেদন প্রত্যাখান করে আদালতে মামলা করেন দিয়াজের মা।
৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শিবলু কুমার দে পুনরায় ময়নাতদন্তের জন্য দিয়াজের মরদেহ কবর থেকে তোলার আদেশ দেন। পরে ১০ ডিসেম্বর পুনঃময়নাতদন্তের জন্য ফের তোলা হয় দিয়াজের মরদেহ। সেই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন শেষে চিকিৎসকরা দিয়াজের শরীরে আঘাতের চিহৃ পাওয়ার কথা জানান।
অবশ্য প্রথম থেকেই দিয়াজকে হত্যা করে তার মরদেহ সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করে আসছিল দিয়াজের পরিবার। সেই দাবির পেছনে দিয়াজের মরদেহ উদ্ধারের দিনের নানা আলামতও তারা তুলে ধরেছেন শুরু থেকেই।
যোগাযোগ করা হলে দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর মা জাহেদা আমিন চৌধুরী বলেন, ‘আমার ছেলেকে হারিয়েছি এই বাসাতেই। সেই বাসায় কিভাবে আর থাকি? তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা অনুরোধ করেছেন তাদের তদন্তের স্বার্থে বাসাটা আপাতত রাখতে। তাই এখনও ছেড়ে দিইনি। তবে আমরা কেউ আর থাকছি না। জানুয়ারি মাস থেকে একেবারে ছেড়ে দেব বাসাটি। ’
জাহেদা আমিন বলেন, ‘আমার ছেলেকে নৃশংসভাবে হারানোর একমাস হয়ে গেল। এখনও জানলাম না আমার ছেলেকে কিভাবে খুন করা হলো। বিচার প্রক্রিয়াও থমকে আছে। দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এখনও প্রকাশ করা হলো না। শুনেছি দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনও প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন আসামিরা সহ প্রথম ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা। আমার ছেলে হত্যার বিচার ছাড়া আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। ’
‘ছেলে হারিয়েছি আমি, এখন তার বিচার চাইতে গিয়েও পরিবারকে একাই লড়তে হচ্ছে। অন্য কারো যেন কোন দায়িত্ব নেই’-বলেন শোকাস্তব্দ এই মা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট্ট চাকরি। পাঁচ সন্তানের বড়জন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর অ্যাডভোকেট জুবাঈদা ছরওয়ার চৌধুরী বিয়ে করে সংসারি। এর পরেরটা দিয়াজ ইরফান চৌধুরী। ছোট দুই মেয়ের একজন সাঈদা ছরওয়ার নিশা পড়ালেখা শেষ করে চাকরিতে ঢুকেছেন বেশ কিছুদিন হলো। ছোট মেয়ে নাহিদা ছরওয়ার নিভা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। আর পরিবারের ছোটজন মিরাজ ইরফান চৌধুরী এবার সুযোগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির।
একটা সময় সন্তানদের শিক্ষার খরচ জোগানোর তাগাদায় চাকরির পাশাপাশি নিজের হাতে বুটিকসের কাপড় তৈরি করে তা বিক্রিও করতেন জাহেদা আমিন চৌধুরী। সব সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় পাঠানোর পর মা জাহেদা আমিনের সেই সংগ্রাম প্রায় 'শেষ'ও হয়েছিল।
এবার ভালোমতোন বাকি জীবন কাটিয়ে দেওয়ার কথাই ছিল তার। কিন্তু সেই স্বপ্নপূরণের শুরুতেই যেন জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলেন আদরের বড় ছেলেকে হারিয়ে।
মা জাহেদা আমিন চৌধুরী স্বপ্ন দেখতেন বড় ছেলে দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর হাত ধরেই তার পরিবারটা এগুবে। মায়ের সেই স্বপ্ন একে একে পূরণের পথে হাঁটছিলেন দিয়াজও। বেঁচে থাকলে হয়তো এতদিনেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালকের চাকরিটা তার নিশ্চিতই হয়ে যেত।
জাহেদা আমিন চৌধুরী বড় ছেলেকে ঘিরে আরও একটা স্বপ্ন দেখতেন, একদিন দিয়াজ ইরফান চৌধুরীই সাধারণ থেকে অসাধারণ করে তুলবেন তাকে। একদিন বড় ছেলের কল্যানেই তাকে দেখাবে টিভিতে, তার ছবি প্রকাশিত হবে পত্রিকা-অনলাইনে।
মা জাহেদা আমিনের জীবনে সেই স্বপ্নটা যেন খুব তাড়াতাড়ি সত্যি হয়ে গেল ! খুব নির্মমভাবে সত্যি হয়ে গেল !
বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৬
টিএইচ/টিসি