চট্টগ্রাম: দেশের ক্রমবর্ধমান অবকাঠামো নির্মাণ ও শিল্পায়নের প্রয়োজনেই জাহাজ ভাঙা শিল্পের বিকাশে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছেন শিল্প মন্ত্রনালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া।
শনিবার (২৪ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) উদ্যোগে জাহাজ ভাঙা ও রিসাইক্লিং শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে মত বিনিময় সভা এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিক কর্মচারীদের মাঝে সনদ বিতরণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে এসব কথা বলেন তিনি।
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘ব্যাংক ঋনে সুদের হার কমানো এবং শুল্কায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সব ধরণের বাধা দুর করা হবে। এ শিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে।
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘দেশে ৬০০ রড তেরির কারখানা আছে। এগুলোর কাঁচামালের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই আসে জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পের সঙ্গে দেশের অন্তত এক কোটি মানুষ জড়িত। ’
পরিবেশবাদীরা এই শিল্পের ব্যাপারে খুবই সক্রিয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘পরিবেশবাদীদের এই তৎপরতা ইতিবাচক। তবে খেয়াল রাখতে হবে কেউ যেন ষড়যন্ত্র করতে না পারে। ইতিপূর্বে বাংলাদেশে একটি জাহাজ আসার পর বলা হলো সেটি তেজস্ক্রিয় পদার্থ বহন করছে। পরে জাহাজটি ভারতে নিয়ে ভাঙা হলে তাতে কোনও তেজস্ক্রিয় পদার্থের অস্থিত্ব মেলেনি। এখন বাংলাদেশে আসা আরও একটি জাহাজ নিয়ে এই ধরণের কথা বলা হচ্ছে। ইতিমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর সেটি পরীক্ষা করছে। ’
শিল্প সচিব বলেন, ‘আশুলিয়ায় কয়েকটি তৈরি পোশাক কারখানায় আন্দোলন শুরু হয়েছে। ফলে সেখানে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এসব কারখানা ফরমায়েশ অনুযায়ী পোশাক যথাসময়ে সরবরাহ করতে পারবে না। তাদের দেওয়া ফরমায়েশ অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। এতে ওইসব দেশ উপকৃত হবে।
বিএসবিআরএ সভাপতি মো. আবু তাহেরের সভাপতিত্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব মিয়া আব্দুল্লাহ মামুন, শিল্প মন্ত্রনালয়ের যুগ্ম সচিব ইয়াসমিন সুলতানা, বিএসবিআরএ সদস্য জহিরুল ইসলাম রিংকু, আবুল কাশেম, এম রহমান ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক জমির উদ্দিন।
জহিরুল ইসলাম রিংকু বলেন, পরিবেশ সংগঠন ‘বেলা’ একবার জাহাজ ভাঙা শিল্পের বিরুদ্ধে মামলা করে। তাতে এক বছর জাহাজ আনা বন্ধ ছিল। এতে দেশে প্রতি টন রডের দাম একলাখ টাকায় উন্নীত হয়। এখন সেই রডের দাম ৪০ হাজার টাকায় নেমেছে।
তিনি বলেন, দেশে শিল্পায়ন যত বিকশিত হবে, জাহাজ ভাঙা শিল্পের ওপর নির্ভরতাও তত বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে জাহাজ ভাঙাকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এটি আমাদের জন্য সম্মানের। সরকারের দেওয়া দিক নির্দেশনা মেনেই এ শিল্প এগিয়ে যাবে।
অপর সদস্য আবুল কাশেম জাহাজ ভাঙা শিল্পের বিকাশে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প নেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং পরীক্ষা নীরিক্ষা ও সনদ দেওয়ার প্রক্রিয়া আরো সহজীকরণের আহবান জানান। তিনি জাহাজ ভাঙা শিল্পকে আরও পরিবেশ বান্ধব করতে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, জাহাজ ভাঙা শিল্প পরিবেশ মন্ত্রনালয় নাকি শিল্প মন্ত্রনালয়ের অধীনে থাকবে তা ঠিক করার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য লৌহজাত শিল্পের কাঁচামাল আমদানীর পরিবর্তে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের স্ক্র্যাপ ব্যবহৃত হওয়ায় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে, যা অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করে দেশকে এটি কাংখিত উন্নতির দিকে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। প্রতি বছর এই শিল্প থেকে প্রায় ১২০০ থেকে ১৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব সরকারী খাতে জমা হচ্ছে। প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৭০ হাজার শ্রমিক এবং পরোক্ষভাবে প্রায় দুই থেকে আড়াই লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এসকল প্রান্তিক শ্রমিক জীবন জীবিকা এই শিল্পের বিভিন্ন কর্মকান্ডের উপর নির্ভরশীল। শিল্পে কর্মরত অধিকাংশ শ্রমিক উত্তরবঙ্গের দারিদ্রপীড়িত অঞ্চলের। কর্মসংস্থানের ফলে তাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় জীবন মান উন্নত হয়েছে। এভাবে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এই শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে।
বর্তমানে বিভিন্ন শিপ ব্রেকিং এন্ড রিসাইক্লিং ইয়ার্ডে জাহাজ কাটিং ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া নোরাড ও সেনস্রেক প্রকল্প বাস্তবায়ন সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, পরিবেশ অধিদপ্তর, কলকারখানা পরিদর্শন কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়ের তদারকি বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে অতীতের তুলনায় বর্তমানে শিপ ব্রেকিং এন্ড রিসাইক্লিং ইয়ার্ড সহ বিভিন্ন কর্মকান্ডের সার্বিক পরিবেশ উন্নত হয়েছে। এ অবস্থায় কমলা-খ শ্রেণীভূক্ত শিপ ব্রেকিং শিল্পকে লাল শ্রেণীভূক্ত করা যথাযথ হয়নি। শিল্পের এই শ্রেণী পরিবর্তনের কারণে ইয়ার্ড লাইসেন্স নবায়নের বিষয়টি পরিচালক, পরিবেশ অঞ্চল অফিস, চট্টগ্রাম এর পরিবর্তে মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকার দপ্তরে নিষ্পন্নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর ফলে সময়ক্ষেপণসহ ইয়ার্ড মালিকদের হয়রানি বৃদ্ধির আশংকা সৃষ্টি হয়েছে। যা এই শিল্প বিকাশের জন্য অনুকুল বলে মনে হয়না।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১৬
টিএইচ/টিসি