বারানসি ঘুরে বেড়ালাম গোটাদিন। কাশী বলেই এ অঞ্চলের সুপরিচিতি।
ঘুরে ঘুরে দেখা গেলো পবিত্র এই শহরের ভোটারদের কদর আছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেলো কিছু তথ্য, কিছু তত্ত্ব। অন্যতম তত্ত্ব হচ্ছে- এবার লোকসভায় বারানসি আসনকে বেছে নিয়েছেন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র মোদী। কৌশলি মোদীর প্রতিদন্দ্বিতাকারী রাজনীতির আরেক চমক আম আদমির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালও লড়বেন এখানে। যাকে অনেকে আবেগী নেতা মনে করেন।
মোদি কৌশল করে ধর্মীয় এই প্রাচীন শহরকে আসন হিসেবে বেছে নিলেও কেজরিওয়াল এখানে এসেছেন মোদীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়তে। আর এ দুজনকে দমাতে কংগ্রেসের প্রার্থী অজয় রায়সহ আরো ৪১ প্রার্থীও প্রস্তুত। অনেকের মতে, এরাই মোদি-কেজরিওয়ালের যুদ্ধটাকে আরো কঠিন করে তুলেছেন।
শহরটি ঘুরে কংগ্রেসের (প্রতীক) পাঞ্জাকে বেশ দুর্বলই মনে হল। শহরজুড়েই ভাসছে মোদির পদ্মফুল। রাস্তায় রাস্তায় কেজরিওয়ালের সাদাকালো ঝাড়ুও (পোস্টারে) বেশ চোখে পড়ার মত। রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়মিত আচারের পরিবর্তন আর দুর্নীতি থেকে মুক্তির আশায় এক দল মানুষ হাতে ঝাড়ু তুলে নিয়েছেন। আপন করেছেন কেজিওয়ালকে।
শহরের কয়েকটি মোড়ে কাঠফাটা রোড়ে রাস্তার দাঁড়িয়ে কেজরিওয়ালের টুপি পরে ঝাঁটা হাতে কয়েকজনকে ট্রাফিকের কাজ করতেও দেখা গেল। কেজরিওয়ালের হয়ে জোর প্রচার চালাচ্ছেন তারা। তবে প্রচারের দাপটে এগিয়ে মোদির বিজেপিই। বেশ বড়সড় গাড়িতে মাইক নিয়ে ছুড়ে চলেছে বিজেপির প্রচারপত্র। কেজরিওয়ালের সাদা কালো পোস্টারের বিপরীতে কংগ্রেস ও বিজেপীর রঙিন প্রচার আর্থিক আধিপত্যের জোরকেও জানান দিচ্ছে।
বারানসি শহরের সিগরায় ভাড়া অ্যাপার্টমেন্টে বিজেপির বিরাট কার্যালয়ে বসে মোদির প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী অশোক দেওয়ান বেশ জোর দিয়েই বাংলানিউজকে বললেন, বারানসিতে মোদিজিই জিতবেন। সেটাই এখানকার মানুষের চাওয়া।
রোহানিয়া, সেবাপুরী, বারানসি ক্যান্টনমেন্ট, বারানসি উত্তর, ও বারানসি দক্ষিণ- বিধানসভার এ পাঁচটি আসনের ভোটাররা ১২ মে লোকসভার ভোট দেবেন। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ দুপ্রার্থীর ভাগ্য লিখবেন তারাই। নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের ভাদোদরার পাশাপাশি নিজের রাজ্যের বাইরে উত্তর প্রদেশের বারানসিতে লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী হয়েছেন।
বারানসি নিয়ে মোদির কৌশলটা কি? প্রশ্ন রেখেছিলাম স্থানীয়দের কাছে। ডাবর কোম্পানির মার্কেটিং অফিসার সঞ্জয় সিং বাংলানিউজকে বলেন, হিন্দুদের কাছে পবিত্র শহর এই বেনারস। ২০০৯ সালে ইস্টার্ন উত্তর প্রদেশে ২২টি আসনের মধ্যে শুধুমাত্র বারানসীর আসন পেয়িছিল বিজেপি। হিন্দুপ্রধান এ শহরকে তাই নিজ এলাকার বাইরে নিরাপদ মনে করেছেন মোদি। তাছাড়া বারানসি হিন্দুদের প্রাচীন শহর হলেও এখানে মুসলিম ভোটার কম নয়। তিনি দেখাতে চান মুসলিমরাও তাকে তাকে ভোট দিয়েছে। এখানে হিন্দু মুসলিম সহাবস্থানও আছে। সেটিও ব্যবহার করতে চান মোদি, মত সঞ্জয় সিংয়ের।
গঙ্গার হরিশচন্দ্র ঘাট এলাকায় বসে কলেজ শিক্ষক সুরেশ শ্রীবাস্তব বলেন, বরাবরই
উত্তর প্রদেশ থেকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়। এ অঞ্চলে বিজেপির অবস্থান অতটা ভাল নয়। তবে মোদি হাওয়ার সুযোগে বিজেপি উত্তর প্রদেশে অবস্থান তৈরি করতে চায়।
এখানে জিতে আশেপাশের এলাকায় প্রভাব ফেলতে চান মোদি, মত সুরেশের।
ব্যবসায়ী জগতে মোদির জনপ্রিয়তা বেশ পুরোনো খবর। বেনারসি শাড়ির জন্য বিখ্যাত বারানসিও ব্যবসা প্রধান শহরও। এ কারণে বিজেপির অবস্থানকে শক্ত বলছে অনেকে।
তবে ব্যবসা প্রধান হলেও ভীষণ অপরিচ্ছন্ন এ শহরের উন্নয়ন তেমন চোখে পড়ে নি।
রাস্তার দুপাশে যেকোন স্থানে ফেলা আবর্জনা শহরের আরেক বৈশিষ্ট্য। দেবতা বলে পোষ্য গরুর গলায় রশি দেয়না কাশীবাসী। রাস্তায় থাকা সেসব গরুর গোবরে বিচলিত হয় অপরিচিত পথিক। হনুমানজির বারানসিতে হনুমানের চলাফেরায়ও বাধা দেয়না শহরবাসী।
এমন পরিবেশ দেখতে দেখতে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা চলে। মোদীর কৌশল পাশাপাশি আসে কেজরিওয়াল প্রসঙ্গ। কথার লাগাম ধরেন বেনারসি শাড়ির ব্যবসায়ী অনীল শ্রীবাস্তব।
বললেন, মোদিকে চ্যালেঞ্জ করার আবেগেই বারানসিতে এসেছেন কেজরিওয়াল।
কেজরিওয়ালের অবস্থান জানতে চাইলে বারানসি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিজয় প্রকাশ যশওয়াল বলেন, কেজরিওয়ালজি শিক্ষিত এবং ভাল মানুষ। কিন্তু তিনি আবেগপ্রবণ। আবেগে পড়ে দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী পদ ছেড়ে দিয়েছেন। এজন্য তাকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ আগের মতো নেই।
তবে যশওয়ালের কথার বিপরীত সুর মিলল একটু দূরেই অপর যশওয়ালের মুখে। কাশির বিশ্বনাথ মন্দিরের বাইরে দাঁড়িয়ে সিধু যশওয়াল বলেন, কেজরিওয়ালের পাশে এখানকার মুসলমানরা আছে। এখানে মুসলিম ভোট অন্য উত্তর প্রদেশের যেকোন স্থানের তুলনায় বেশি। মুসলমানরাই চমক দেখান।
তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, মুসলিম ভোট ভাগ হয়ে যেতে চলেছে বারনসিতে। মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টির প্রার্থী বিজয় প্রকাশ যশওয়াল, মোলায়েম সিং যাদবের বহুজন সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী কৈলাস চৌরাশিয়া এবং কংগ্রেসের অজয় রায়ের বাক্সেও যাবে মুসলিম ভোট। তবে যদি সব মুসলিমরা এক হয়ে যায় সেক্ষেত্রে নাটকীয় ফল দিতে পারে বারানসি।
এদিকে মোদি-কেজরিওয়ালের বাইরে শক্ত অবস্থানে আছেন কংগ্রেস প্রার্থী ও বারানসির সাত বারের বিধায়ক অজয় রায়। স্থানীয়রা বলছেন, বারানসির সন্তান অজয় রায় মানুষ হিসেবে খুবই ভাল হলেও দুই হেবিওয়েট প্রার্থীর জন্য এ আসনে পেরে উঠতে নাও পারেন। যদিও মুসলিমদের একাংশ কওমী মুসলিম পার্টির নেতা মুক্তার আনসারি প্রকাশ্য অজয় রায়কে সমর্থন দিয়েছেন। তবে জনস্রোতে কথা আছে, অজয় রায়ের ভাই হত্যার প্রধান আসামি মামলা থেকে বাঁচতেই তাকে সমর্থন করেছে।
এদিকে শেষ দফা নির্বাচনী প্রচারণায় নিজ আসনে ভোট চাইতে বুধবার বানারসিতে মোদির রোডশো করতে আসার কথা থাকলেও নিরাপত্তার কারনে নির্বাচন কমিশন সফরটি বাতিল করেছে।
তবে শহরে সন্ধ্যার দিকেও বেশ কড়াকড়ি নজরে পড়লো। বিদেশি পর্যটকদের ভিড় জমানো এ শহরের প্রতিটি হোটেলে সিআইডি বিদেশি রাখতে নিষেধ করে দিয়েছে। বেশ বিপাকে রয়েছেন ভ্রমণকারীরা। বাধ্য হয়ে তারা সফরের সময়ও সংক্ষিপ্ত করছেন।
নির্বাচন কমিশনের বিধিনিষেধের কারণে শহরে পোস্টারের জৌলুস না থাকলেও মানুষের মধ্যে মোদি-কেজরিওয়ালের মত হেবিওয়েট প্রার্থীদের নিয়ে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। ১২ তারিখের নির্বাচনের মাত্র চার দিন পরেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা হবে। বারানসিবাসীর অপক্ষোর পালা খুব দীর্ঘ হবে না।
বাংলাদেশ সময়: ০১০৩ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০১৪