কলকাতা: কথায় বলে পায়ের তলায় সরষে। আর আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের ক্ষেত্রে এই কথাটা যেন ভীষণভাবে সত্যি।
এই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে কলকাতায় বিগত তিন বছরের বিভিন্ন মুহূর্ত, নানা ইস্যু এবং অবশ্যই কলকাতার সংস্কৃতি এবং মানুষজনের কথা। আবিদা প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবাংলা তথা ভারতের প্রতি তার গভীর আন্তরিকতা। কখনো একজন কূটনীতিক, কখনো একজন সাধারণ মানুষ আবার কখনো একজন মা হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন খোলামেলাভাবে।
সাক্ষাৎকারে তিস্তাচুক্তি, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, কলকাতায় কাজ করার সুখস্মৃতির কথা উঠে এসেছে। শুধু সুখস্মৃতিই নয়, উঠে এসেছে কিছু আক্ষেপের কথাও।
বাংলানিউজ: কূটনীতিকের জীবন একজন মানুষকে এক দেশ থেকে অন্যদেশে কাজের তাগিদে ভাসিয়ে নিয়ে বেড়ায়। কলকাতায় বাংলাদেশ উপ হাইকমিশনার হিসাবে আপনার অভিজ্ঞতার কথাই প্রথমে শুনতে চাই।
আবিদা ইসলাম: এক কথায় বলতে গেলে, কলকাতায় কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার খুবই ভাল এবং নিবিড়।
বাংলানিউজ: কলকাতায় যখন প্রথম এলেন, ঠিক কী মনে হয়েছিল?
আবিদা ইসলাম: আসলে একটা ‘মিক্সড ফিলিং’ ছিল। যখন প্রথম পোস্টিং হল তখন আমার দেশের কাছাকাছি একটা জায়গা- এটা ভেবে আনন্দ লেগেছিল। তবে অনেক বড় দায়িত্ব, একজন নারী হিসেবে কাজ করার একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ এই জায়গাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর। তবে আমি এই ধরনের কঠিন চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসি।
বাংলানিউজ: পশ্চিমবঙ্গের অনেকটা জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের সীমান্ত। দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কলকাতা উপ-হাইকমিশন দপ্তর কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে?
আবিদা ইসলাম: এই প্রসঙ্গে বলতে পারি, কলকাতা উপ-হাইকমিশন দপ্তর খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। প্রতি মাসে সাধারণভাবে প্রায় ৩০০-৪০০টি ভিসা হয়। ঈদ ও শারদ উৎসবের সময় মাসে হাজারের উপর ভিসা হয়। এছাড়া আছে, বাংলাদেশ থেকে আগত শিক্ষার্থী, এই দেশে বসবাসকারী মানুষদের বাংলাদেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের বিষয়।
দিল্লি হাইকমিশন দপ্তর নীতি নির্ধারণের কাজ করে। আর কলকাতা উপ-হাইকমিশন সেই নীতির প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে।
এছাড়াও সীমান্তবর্তী রাজ্য হওয়ায় সীমান্ত সংক্রান্ত বিষয়, বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয় ইত্যাদি নানারকমের বিষয়ে প্রতিদিন কাজ হয়। মিশনে ৪৬ জন আধিকারিক আছেন। প্রত্যেকের জন্য এক একটি নির্দিষ্ট দায়িত্বও আছে।
ধরুন, কেউ চিকিৎসা করাতে এসে তার সমস্ত কাগজপত্র হারিয়ে ফেললো বা বাংলাদেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীর কোনো সমস্যা হলো, তখন প্রতিটা মুহূর্তে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় উপ-হাইকমিশন দপ্তর। এছাড়া নানা অনুষ্ঠান এবং দৈনন্দিন কাজ তো আছেই।
বাংলানিউজ: কলকাতায় তিন বছরের মতো কাটালেন, শহর কলকাতা সম্বন্ধে কী স্মৃতি নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন?
আবিদা ইসলাম: আমাদের যাযাবরের জীবন। বলতে পারেন আমরা ‘স্বভাব যাযাবর’। স্মৃতির কথা যদি বলেন, বলতে পারি অনেক। এখন আমার দাদারা সবাই বাংলাদেশে চলে গেছেন। একসময়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের বাড়ি ছিল উত্তর দিনাজপুর।
কলকাতা আমার কাছে সংস্কৃতির পীঠস্থান। যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, নবনীতা দেবসেন, হৈমন্তী শুক্লা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে পড়ে ও দেখে বড় হয়েছি, কাছ থেকে তাদের দেখার সুযোগ হলো। এটা আমার কাছে একটা বড় পাওয়া।
বাংলানিউজ: পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের সঙ্গে কাজ করলেন, কী ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে?
আবিদা ইসলাম: অবশ্যই ভাল।
বাংলানিউজ: আপনি পশ্চিমবঙ্গে বিগত বামফ্রন্ট আমল এবং বর্তমান তৃণমূল সরকারের কাজ কাছ থেকে দেখলেন। বাংলাদেশ নিয়ে দুই সরকারের ভূমিকা কতটা সদর্থক?
আবিদা ইসলাম: দুই সরকারই আমাদেরকে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন।
বাংলানিউজ: পশ্চিমবঙ্গের জনগণের বাংলাদেশ সম্পর্কে উৎসাহ এবং একে-অপরের সঙ্গে আদান-প্রদান সম্পর্কে উৎসাহ কতটা বলে আপনার মনে হয়?
আবিদা ইসলাম: আমি মনে করি, যথেষ্ট উৎসাহ আছে। তবে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বাড়লে এই উৎসাহ আরও বাড়বে বলে আমার মনে হয়।
বাংলানিউজ: ভারত বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কে সম্ভাবনার বিষয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
আবিদা ইসলাম: আমি খুবই আশাবাদী।
বাংলানিউজ: কোন কোন ক্ষেত্রে বাণিজ্যের সম্ভাবনা আছে বলে আপনার মনে হয়?
আবিদা ইসলাম: অনেক ক্ষেত্রেই এই সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশ থেকে কাঁচামাল ভারতে রফতানি করার আরও সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বিপুল সুযোগ আছে।
বাংলানিউজ: জলবণ্টন চুক্তির কথায় আসি। তিস্তা চুক্তি নিয়ে সবপক্ষই যথেষ্ট সরব। কিন্তু মোট ৫২টি নদী ভারত-বাংলাদেশের উপর দিয়ে গেছে। এই নদীগুলির জল বণ্টন নিয়ে আপনার অভিমত কী?
আবিদা ইসলাম: দেখুন, গঙ্গা ছাড়া আমরা কিছুই পাইনি। এক তিস্তাচুক্তির সমাধানের চেষ্টাই গত ২-৩ বছর ধরে চলছে। আমরা চাই, সঠিক নদী-নীতির মাধ্যমে এই বিষয়গুলির সমাধান করতে। আমি আশাবাদী।
বাংলানিউজ: একে-অপরের সঙ্গে সম্পর্ক আরো ভালো করতে দুই বাংলার এই মুহূর্তে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
আবিদা ইসলাম: সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের বিষয় তো আছেই। এছাড়া বাণিজ্যিক আদান প্রদান বাড়ানো অবশ্যই দরকার। এর ফলে দুই দেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে।
বাংলাদেশের তরফে রফতানি বাড়াতে হবে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের দিকে রাস্তাসহ পরিকাঠামো আরও কিছুটা উন্নতি করতে পারলে সুবিধা হবে। এছাড়া ভারতের তরফে আইনি পদ্ধতির সরলীকরণ করলে বাণিজ্য আরও বাড়তে পারে বলে আমার মনে হয়।
বাংলানিউজ: যদি এই বিষয়টি একটু বিস্তারিত বলেন।
আবিদা ইসলাম: আপনি নিশ্চয় সীমান্ত এলাকাগুলি দেখেছেন, সেখানকার রাস্তাঘাট দেখেছেন। সেখানে পরিকাঠামো বৃদ্ধি করার সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয়। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ থেকে আসা জিনিস পরীক্ষা করতে দক্ষিণ ভারতে পাঠানো হয়। এটা কিছুটা সময়সাপেক্ষ বিষয়। আর সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পণ্য রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বাড়তে থাকে।
ভোক্তাদের কথা মাথায় রাখতে হবে। তাদের কাছে সঠিক দামে পণ্য পৌঁছাতে গেলে এই খরচ কমানো দরকার।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রচারে উপ-হাইকমিশন অনেক কাজ করেছে। কিন্তু কলকাতার সাধারণ মানুষের কাছে সেটা কতটা পৌঁছানো গেছে বলে আপনার মনে হয়?
আবিদা ইসলাম: দুই দেশের সংস্কৃতির বিষয়ে অনেক কাজ হয়েছে। আমার বিশ্বাস, এর মাধ্যমে আমরা পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি।
বাংলানিউজ: এবার একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন। এই চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যে নিজের অবসরের জন্য সময় বের করতে পারেন?
আবিদা ইসলাম: (একটু হেসে) প্রায় পারি না বললেই চলে। এখানে অনেক সময় ছুটির দিনেও কাজ করতে হয়। খুবই দায়িত্বপূর্ণ কাজ। ছুটির দিনেও কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে যাবার থাকে। আমার এগুলি ভালো লাগে। আর ১৯ বছরের কর্মজীবনে অভ্যস্তও হয়ে গিয়েছি।
বাংলানিউজ: আপনার কন্যা আপনার সাথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আপনার কি মনে হয় না এর ফলে তার শৈশবের গড়ে ওঠা বন্ধুত্বের শিকড়, বন্ধুদের সাথে একসাথে বড় হবার মজা এইগুলি থেকে সে বঞ্চিত হচ্ছে?
আবিদা ইসলাম: আমাদের পায়ের তলায় সর্ষে। কলকাতাতে প্রথম এক বছর আমার কন্যার বেশ কিছুটা অসুবিধা হয়েছিল। নতুন শহর, নতুন মানুষজন। সেই সময় তাকে যথেষ্ট সময় দিতে হয়েছিল। মা হিসেবে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি। একসঙ্গে সিনেমা দেখেছি, রেস্টুরেন্টে খেতে গেছি। ধীরে ধীরে পুরো বিষয়টা স্বাভাবিক হয়েছে।
বাংলানিউজ: সিনেমার কথা যখন উঠল জানতে ইচ্ছা করছে, আপনার প্রিয় সিনেমা কি?
আবিদা ইসলাম: সিনেমা দেখতে আমি ভালোবাসি। কিন্তু কাজের ব্যস্ততার মাঝে আর দেখা হয় না।
বাংলানিউজ: তিন বছরের মধ্যে আপনার সব থেকে আনন্দের স্মৃতি কী?
আবিদা ইসলাম: (একটু হেসে) আমি কলকাতাকে একটি ‘সাংস্কৃতিক হাব’ বলে মনে করি। সব থেকে আনন্দের বিষয় কলকাতায় আমার একটা শিকড় রয়ে গেল।
বাংলানিউজ: কোনো আক্ষেপ আছে? যেটা নিয়ে আপনি ফিরে যাচ্ছেন?
আবিদা ইসলাম: (বেশ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে) আক্ষেপ একটাই! যদি তিস্তাচুক্তিটা সম্পন্ন করে যেতে পারতাম!
বাংলানিউজ: আশা করি, আপনার ভবিষ্যৎ জীবন সুখের এবং সফলতায় পরিপূর্ণ থাকবে। বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন আগামী দিনে দুই বাঙলার সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপনার প্রচেষ্টার কথা অবশ্যই সকলে মনে রাখবে। আপনার সুস্থ জীবন কামনা করি। বাংলানিউজকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আবিদা ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, ২৮ সেপ্টম্বর , ২০১৪